১৯৫০ সাল; বঙ্গবন্ধু তৎকালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা দাবি করার অপরাধে কারারুদ্ধ হয়ে খুলনার জেলখানায়। সেখানকার পুলিশ সুপার একদিন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, শেখ সাহেব, আপনি কেন জেল খাটছেন? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, 'ক্ষমতা দখল করার জন্য।' জেল সুপার আবারও প্রশ্ন করলেন, ক্ষমতা দখল করে কী করবেন? এর উত্তর ছিল 'যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করব।' আজকে বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই কাজটিই করছে। সেই সময়ে এই কভিড-১৯ এর বিশ্বমন্দার মধ্যেও দেশটাকে অশান্ত করার জন্য কিছু দুষ্টচক্র সমাজবিরোধী নানা কাজে লিপ্ত হয়ে দেশের মধ্যে একটি আস্থার সংকট সৃষ্টি করতে যারপরনাই লিপ্ত।

স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। পাকিস্তান থেকে যেদিন স্বাধীন হয়েছিলাম সেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর; দেশটি একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত ভূখণ্ড ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেদিন অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, এ দেশকে বাঁচানো যাবে না। কমপক্ষে সাড়ে সাত কোটি লোকের তিন কোটি লোক অর্ধাহার-অনাহারে মারা যাবে। কারণ আমাদের না ছিল যানবাহন, না ছিল রাস্তাঘাট, না ছিল চিকিৎসার ব্যবস্থা, রেল সংযোগ, সেতু, কালভার্ট এমনকি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত সেতুটি যুদ্ধবন্দি হওয়ার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল। দেশের মানুষ একাত্তর সালে ফসল ফলাতে পারেনি। কারণ সারাদেশে যুদ্ধের ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চলছিল। ফলে দেশ যেদিন স্বাধীন হলো, সেদিন প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের তিন ভাগের এক ভাগও আমাদের মজুদ ছিল না।

একাত্তরের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় আসন্ন; পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারল- এ দেশকে আর দখলে রাখা যাবে না, তখন তারা জাহাজ ও উড়োজাহাজ ভর্তি করে দেশের যত সম্পদ পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল সবই নিয়ে গেল। যেসব খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য সামগ্রী নিতে পারল না, সেগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। তারা এই ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। লাখো বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। হিন্দু, মুসলমান, উপজাতি নির্বিশেষে সব মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের একমাত্র বড় শহর ঢাকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে আর যখন ব্যবহার করতে পারছিল না, তখন মাইন পুঁতে এই সমুদ্রবন্দরকে অকার্যকর করে রেখে গিয়েছিল। দেশের তহবিলে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, যা ব্যবহার করে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে মানুষের দৈনন্দিন অভাব পূরণ করা যায়।

এই অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর সুষ্ঠু পরিকল্পনার ফলে ও জনগণের সার্বিক সমর্থনের মাধ্যমে এক কোটি দেশত্যাগী মানুষকে ফিরিয়ে এনে, দুই কোটি আশ্রয়হীন মানুষকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে স্বাধীন বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে আমরা বিশ্বের প্রায় সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হই। সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমাদের স্কুল-কলেজের ছাত্রদের একটি বিরাট অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ করতে সক্ষম হই।

দেশের স্কুল-কলেজ এমনকি প্রাইমারি স্কুল পাকিস্তানি দস্যুরা ধ্বংস করে রেখে যায়। স্বাধীনতার পর সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে সব স্কুল-কলেজ পুনর্নির্মাণ করে শিক্ষা ও পাঠদান করা সম্ভব হয়। কৃষিক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা দানের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বোঝাপড়া যখন হলো না; তার পরও দেশের কৃষকদের অর্থ সাহায্য দিয়ে ফসলের উৎপাদন অনেক গুণ করার ফলে খাদ্যশস্যের বিশেষ করে ধান-চালের অভাব অনেকাংশে পূরণ করা হয়। এসব ছিল আমাদের কাছে সেই সময় স্বপ্নাতীত। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য নেতৃত্বে দেশে চালের দাম ৫ টাকা সেরে নেমে এসেছিল। প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এ অবস্থার মধ্যেই ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে পাকিস্তানের অনুচরেরা আমেরিকার প্ররোচনায় বাংলাদেশকে অকার্যকর করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়।

২৯ বছর বহু ত্যাগ, লাখ লাখ জীবনদান, অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেই পাকিস্তানি দস্যু, অনুদাসদের বিতাড়িত করে জনগণের সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজও নানা ছলে ও কৌশলে এই স্বাধীন দেশটিকে অকার্যকর করার চেষ্টায় এক শ্রেণির মানুষ লিপ্ত। তারা প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে দেশকে অশান্ত দেখানোর চেষ্টা করছে। তাদের সন্ত্রাস, খুন-খারাবি, জ্বালাও-পোড়াও, এমনকি ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোর স্থানীয় ও সার্বিক চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এদের খাসলত যায় না মলে। তাই তারা আজও প্রতিটি ঘটনাকে তিল থেকে তাল করে একটি অশান্ত দেশ হিসেবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে পরিচয় করানোর ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত।

যেভাবে আমরা ধর্মীয় মৌলবাদ, সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও ও ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের সম্মিলিতভাবে পরাভূত করেছি। একইভাবে আমাদের মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের সন্তান-সন্ততির উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের প্রত্যাশাকে বাস্তবায়ন করতে কাজ করে যেতে হবে। এ দেশের মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে যে বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে; তা থেকে মুক্তি দিতে আজকে আমাদের মাঝে যে সার্বিক ঐক্য জননেত্রী শেখ হাসিনা নিয়ে এসেছেন, তাকে দৃঢ় করতে হবে। তাহলেই আমাদের জীবন শান্তিময় হবে। সুখের দিনের আশায় ভবিষ্যৎ বংশধরকে আমরা অনুপ্রাণিত করতে পারব ও বিশ্বসমাজে সম্মানের আসন পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে।

সভাপতি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ