সেনাশাসক জিয়াউর রহমান যেদিন তার 'মর্জিমাফিক গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি তথাকথিত রাজনৈতিক পল্গ্যাটফর্ম গঠনের জন্য পল্টনের কোনো এক ভবনে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আমাকে সেখানে যেতে হলো। ইত্তেফাক সম্পাদক আমাকে নির্দেশ দিলেন এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন, কাজেই রিপোর্ট খুব সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। রিপোর্ট করার সময় আমি যেন দেশে সামরিক শাসনের কথাটা মাথায় রাখি। ইত্তেফাকের পক্ষ থেকে সম্পাদক নিজেই প্রশ্ন করলেন আর আমার কাজ ছিল নোট নেওয়া। যদিও রিপোর্টটি লিখতে হলো আমাকেই। যতদূর মনে আছে, সেখানে জিয়াউর রহমান মিলিটারি কমান্ডারের মতো কাঠখোট্টাভাবে বক্তব্যের শেষের দিকে কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, যার মূল নির্যাস হচ্ছে- দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে হবে। বাকশালের একদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে 'বহুদলীয় গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করতে হবে।

সেই রাতে অফিসে ফিরে আমি যে রিপোর্টটি করেছিলাম তার শিরোনাম থেকে শুরু করে ভেতরের রিপোর্টের খোলনলচেও সম্পূর্ণ বদলে তারপর ছাপা হয়েছিল। মনে আছে, আমি রিপোর্টটির শিরোনাম দিয়েছিলাম বোধহয় এ রকম- 'যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগ ঠেকাতে হবে'। শোল্ডার হেডিং ছিল- 'প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়ার আহ্বান'। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এই শিরোনাম আর সংবাদটি শ্যেনদৃষ্টিসম্পন্ন বার্তা ও নির্বাহী সম্পাদক এবং সহকারী বার্তা সম্পাদকের বিশ্নেষণের কারণে আমূল বদলে গিয়েছিল। চার দশকের অধিককাল আগের এই ঘটনার কথা মনে পড়ল এ কারণে যে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়েছিল, সেটি এতেই যথেষ্ট স্পষ্ট হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। আমাকে তখন ইত্তেফাকের রিপোর্টিং থেকে সরিয়ে 'সহকারী সম্পাদক' পদে উন্নীত করা হয়েছে। পদমর্যাদা বেড়েছে বটে, তবে কমেছে দুটি জিনিস- টাকার অঙ্ক, যেহেতু চিফ রিপোর্টারের ভাতা কেটে দেওয়া হয়েছে। কেটে দেওয়া হয়েছে আরও দুটি ভাতা এবং মূল বেতনের স্কেলটিও কিঞ্চিৎ তারতম্য করে কী যে এক অদ্ভুত কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে, যার কারণে মূল বেতনটিও হ্রাস পেয়েছে। আর কমেছে রিপোর্টিং নিয়ে খবরদারি, যাকে বলা যেতে পারে কর্তৃত্ব। ইচ্ছে করলেই কোনো রিপোর্ট নিয়ে পরামর্শ কিংবা লেখার অধিকারটিও আমারই অজ্ঞাতসারে লুপ্ত হয়েছিল।

আমিও অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে খুশি হলাম এই কারণে যে, আমার খাটতে হবে কম, পরিবারকে সময় দেওয়া যাবে বেশি আর টেলিভিশনে অনুষ্ঠান নিয়ে মাথাও খাটানো যাবে। বিশেষ করে তখন বিবাহিত জীবন শুরু হয়েছে মাত্র বছর দুই-তিন আগে। সত্যি বলতে কি আমিও যৎকিঞ্চিৎ তুষ্টই ছিলাম। তখন সম্পাদকীয় বিভাগে বিশাল বিশাল কলাম লেখক উপ-সম্পাদকীয় পৃষ্ঠাটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অতিথি কলাম লেখক হিসেবে রয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ, তার শিষ্য খন্দকার আবদুল হামিদ। তাদের দু'জনেরই একান্ত অনুগত আখতারুল আলম। আরও আছেন হাবিবুর রহমান মিলন, রাহাত খান, মহাদেব সাহার মতো প্রগতিশীলরাও। এদের মধ্যেই আমার ঠাঁই হলো।

কলাম লেখক হিসেবে আমি একেবারেই নবাগত। আমার কাছাকাছি সময়ে পূর্বদেশ থেকে যোগদান করলেন জিয়াউল হক। তিনি তখন কলাম লিখতেন। খন্দকার আবদুল হামিদ একদিন বোধহয় সম্পাদক কিংবা ব্যারিস্টার সাহেবকে আমার প্রসঙ্গে বলেছিলেন কথায় কথায় যে, 'এই ছোকরার লেখার হাত আছে, কলাম ভালো লিখবে বলে মনে হয়। তাকে দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে।' তাতেই আমার কলামিস্ট জীবনের সূত্রপাত। আমি আমার কলামিস্ট জীবনের জন্য এই পাকিস্তানপন্থি কলামিস্ট খন্দকার আবদুল হামিদের কাছে কৃতজ্ঞ।

কিন্তু যে ঘটনা বিবৃত করার জন্য এই লেখা তা হলো, একদিন দুপুরবেলায় স্পষ্টভাষী নামে পরিচিত খন্দকার আবদুল হামিদ আমাকে ফোন করে বললেন, আপনি কি বাংলা একাডেমির সদস্য? হ্যাঁ সূচক উত্তর দেওয়ার পর তিনি বললেন- আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ আছে, সেটি আমি কাল উপস্থাপন করতে যাচ্ছি। আপনি আসুন। এতে আপনার চিন্তার জগৎ প্রসারিত হবে।

আমার চাকরিক্ষেত্রে এই ভদ্রলোক তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এবং আমার কলামিস্ট জীবন তার সুপারিশেই শুরু। অতঃপর গেলাম বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। নিবন্ধ পাঠ করছেন মাথায় জিন্নাহ টুপি পরা খন্দকার আবদুল হামিদ, যাকে আমার পেশাগত জীবনের গুরু শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে ঘাতকদের সঙ্গে সংশ্নিষ্টতার জন্য অনেকের মতো আমিও সন্দেহ করতাম। দর্শকদের এবং শ্রোতাদের হাতে খন্দকার আবদুল হামিদ লিখিত একটি বুকলেট পৌঁছে দেওয়া হলো। আমি সেই বুকলেট পকেটে করে সেখান থেকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হলাম।

আসলে ওই নিবন্ধটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তনের ধারণাপত্র। এর উপস্থাপনার কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন খন্দকার আবদুল হামিদ আর এই ভাবনাটি ছিল আবুল মনসুর আহমদের মস্তিস্কপ্রসূত। জেনারেল জিয়ার পরিকল্পনায় সুনিপুণভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এই বিষাক্ত দর্শন; যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ এবং শ্রেণি-শোষণের ধারণার বিরুদ্ধাচরণ করে চলেছে অদ্যাবধি। এভাবেই জিয়া এবং তার গুরু কিংবা অনুসারীদের সম্মিলিত প্রয়াসে একাত্তরের অর্জনগুলো একে একে নষ্ট করা হয়েছে। তার এই কাজের পুরস্কার হিসেবে তিনি জিয়ার দৈনিক পত্রিকা 'দেশ'-এর সম্পাদক হয়েছেন, প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন, পুরো মন্ত্রীও হয়েছেন। অনেকটা কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মতো।

আজকাল অনেকেই রাজনীতিতে কিংবা টিভি আলোচনায় ভারসাম্যের কথা ভাবেন। মনে করেন একজন মুক্তিযুদ্ধের উল্টো দিকে একজন রাজাকারপন্থি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, একজন শেখ হাসিনার পাল্টা হিসেবে খালেদা কিংবা শেখ মুজিবের বিপরীতে জিয়াউর রহমানকে দাঁড় করালেই বুঝি নিরপেক্ষতা বজায় রাখা গেল। তারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একাত্তরের পরিবর্তে সাতচল্লিশ, ২৬ মার্চের পরিবর্তে ১৪ আগস্ট এবং শেখ মুজিবের পরিবর্তে জিন্নাহ প্রতিষ্ঠা করার গুপ্ত সংগঠক।

যারা মনে মনে কষ্ট পান এই ভেবে যে, বিএনপির মতো একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, তাদের জন্য একটি কথা আমি গত চারটি দশক ধরেই বলে আসছি। কথাটি হলো- যে রাজনীতির জন্ম ঘটে সেনা ছাউনির মধ্যে, সেই রাজনীতি কখনোই জনগণের রাজনীতি হতে পারে না। ইতিহাসের নিয়মেই ওই ধরনের রাজনৈতিক দর্শনের অবলুপ্তি অনিবার্য। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তো এরই নির্মোহ এবং নির্দয় সাক্ষী।

'মসনদি দল' হিসেবে বিএনপির আয়ু অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ এটা মানতেই হবে। তবে এটা পুরোপুরিই ঘুণে ধরা। যদিও বাইরের কাঠামোটা ঠিক আছে এখনও। এই ঠিক থাকাটাও খানিকটা সরকারি দলের রাজনীতিরই বদান্যতা। সরকারি দলের রাজনীতির দ্বিধাগ্রস্ত ভ্রান্তির বিলাসিতা এখনও বিএনপির বহিরাবরণ টিকিয়ে রেখেছে। আরও একটা বিপজ্জনক বাস্তবতা হচ্ছে- ভগ্নস্তূপের মধ্যে যেমন সর্প বা শৃগালের আবাস গড়ে ওঠে, ঠিক তেমনি বিএনপি নামক পোড়োবাড়ির স্তূপেও বাসা বাঁধছে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদী মনমানসিকতার হিংস্র শ্বাপদকুল।

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভিন্নমত প্রকাশের ব্যবস্থা থাকা উচিত- একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা আমিও বিশ্বাস করি। আমিও বিশ্বাস করি যে, অন্ধ করতালি কখনও সত্য অন্বেষণে সাহায্য করে না। আমি এটাও জানি, একই বাক্যের প্রতিধ্বনি কেবল ধ্বনিটিকেই ব্যঙ্গ করে। কিন্তু তার অর্থ তো এই নয়, বিরোধিতার নামে মূল শরীরটাকেই চুরমার করে দিতে হবে। আমি মনে করি, বিএনপির বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। এখন তার গলিত দেহ কেবল দুর্গন্ধই ছড়াবে। অতএব দেশ, জাতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা এবং অতিসত্বর এই গলিত মৃতদেহের সৎকার অত্যন্ত জরুরি।

সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ