করোনাকালে দেশে দারিদ্র ও অতিদারিদ্র্যের হার বেড়েছে- পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য-উপাত্ত উদ্ৃব্দত করে শনিবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনের এমন ভাষ্য আমাদের উদ্বিগ্ন করলেও বিস্মিত করে না। বস্তুত কেবল বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক এই দুর্যোগে বিশ্বব্যাপীই অর্থনীতি ও উন্নয়নের সূচকে নিম্নগামী। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে অন্তত ৪০ কোটি মানুষ নতুন করে চরম দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। বাংলাদেশেও গত কয়েক মাসে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে, যারা টিকে আছেন তাদেরও অনেকের বেতন-ভাতা হ্রাস পেয়েছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় ও মুনাফা কমেছে। এই চিত্র দেখা যাচ্ছে চারপাশে দৃষ্টি রাখলেই। আমাদের মনে আছে, গত এপ্রিলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের পক্ষে সারাদেশের নিম্ন আয়ের নাগরিকদের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গিয়েছিল করোনাকালে ৭৫ শতাংশের আয় কমেছে। দরিদ্রদের ৮৯ শতাংশ নেমে এসেছে অতিদরিদ্রের সারিতে। আসলে এই পরিস্থিতি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের গত অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরের শেষে দারিদ্র্যের হারের প্রাক্কলন জনধারণাকেই তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়েছে মাত্র। যদিও আমরা এতটা শঙ্কা করিনি যে, দেশে দারিদ্র্যের হার কমবেশি ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে উঠে যাবে এবং অতিদারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়ে কমবেশি ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে ঠেকবে। এও ভুলে যাওয়া চলবে না যে, কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি গবেষণা সংস্থার হিসেবে এই হার আরও বেশি। যেমন সিপিডি বলছে, করোনাকালে অতিদারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। সানেমের হিসেবে তার ৪০ শতাংশের বেশি। সরকারের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের একজন সদস্য যদিও বেসরকারি এসব হিসাব 'উড়িয়ে' দিতে চান, আমরা মনে করি ওই হিসাবগুলোও আমলে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জরিপ বা গবেষণার সরকারি প্রক্রিয়াতেই বরং পরিস্থিতির নাজুকতা কম করে দেখানোর একটি দশক প্রাচীন প্রবণতা রয়েছে। এও ভুলে যাওয়া চলবে না, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির এই প্রবণতা সরকারের ব্যর্থতার বিষয় হতে পারে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতিরই স্থানীয় প্রতিফলন মাত্র। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি অস্বীকারের চেয়ে মেনে নিয়ে তার মোকাবিলায় সদিচ্ছার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আমরা দেখছি, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ ও পদক্ষেপের ঘাটতি ছিল না। বরং সবাই স্বীকার করছে যে- করোনাকালেও দারিদ্র্য হ্রাসে বা নিয়ন্ত্রণে সরকারের দিক থেকে নিম্নবিত্তের কাছে নগদ অর্থ পৌঁছানো, শিল্প ও কৃষি খাতে সহায়তা দিয়ে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখার আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখা গেছে।
যদিও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা মাঠ পর্যায়ে কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, সেই প্রশ্ন রয়েই গেছে। দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে গত এক দশকে সরকারের অব্যাহত সাফল্যের বিষয়টিও বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। আমাদের মনে আছে, গত বছর জুলাইতেই বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকে (এমপিআই) বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করেছিল। এর অর্থ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের পথে আমরা কাঙ্ক্ষিত গতিতেই ছিলাম। এমপিআই সূচক যেহেতু স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবনমান ও কর্মসক্ষমতা বিবেচনা করে থাকে, সেই অগ্রগতি ছিল সামাজিক ক্ষেত্রেও ইতিবাচক পরিস্থিতির প্রমাণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক বিভিন্ন সূচকে গত দুই-তিন দশকে বাংলাদেশ যে ক্রমাগত এগিয়ে গেছে, এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা তা অনেকবার বলেছি। বিশেষত গত এক দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে যেভাবে দেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক বেষ্টনীমূলক কর্মসূচির আওতা বাড়িয়েছে; যেভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সর্বাত্মক মনোযোগী হয়েছে; তাতে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য অস্বাভাবিক ছিল না। দারিদ্র্য সূচকে সাময়িক এই নিম্নগতির সময় আমরা দেখতে চাই, পরিস্থিতি মোকাবিলাতেও দ্বিগুণ উদ্যোগ। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন সরকারি প্রণোদনা, সহায়তা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীমূলক কর্মসূচিগুলোর সুচারু বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে; তেমনি নিতে হবে কর্মসংস্থানমূলক নতুন নতুন কর্মসূচি। সবাই মিলে চেষ্টা করলে দারিদ্র্যসূচকে সাময়িক দুরবস্থা নিশ্চয়ই কেটে যাবে।
মন্তব্য করুন