
করোনাভাইরাসের পরীক্ষার নামে ভুয়া সনদ বিক্রির দায়ে গত জুলাই মাসে গ্রেপ্তার ডা. সাবরিনা চৌধুরী পেশায় একজন চিকিৎসক; অর্থাৎ উচ্চ ডিগ্রিধারী। তার পেশাগত দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে অঢেল টাকা রোজগারের নেশায় যে চরম অমানবিক-অনৈতিক মিথ্যা সার্টিফিকেট বাণিজ্যে জড়িত হলেন, তাতে কি তাকে শিক্ষিত বলা যায়? একইভাবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তারাও উচ্চ ডিগ্রিধারী। অথচ তাদের অনেকেই আছেন, যাদের ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। এরা চাকরি জগতে প্রবেশের পর যে দেশের মানুষের পয়সায় প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সনদ লাভ করেছেন, সেই মানুষদের প্রতি তাদের কর্তব্য ভুলে যান।
আমরা কাকে 'শিক্ষিত' বলব? বিদগ্ধজনদের মতে, একজন শিক্ষিত মানুষ নিজেকে সর্বাগ্রে একজন মানুষ হিসেবে ভাবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তার লব্ধ জ্ঞান সমাজের অন্যান্য মানুষের কল্যাণার্থে প্রয়োগের চেষ্টা করে। একজন শিক্ষিত মানুষ আশপাশের সবাইকে তার মতোই মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে; সে অন্যের বিপদ-আপদে তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়; সর্বোপরি একজন শিক্ষিত মানুষ তার মাতৃভূমি এবং স্বদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ ডিগ্রিধারীর মধ্যে আমরা এসব আচরণ দেখি না বললেই চলে। তাহলে আমরা কীভাবে তাদের শিক্ষিত বলব? আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উলেল্গখ করার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন যথার্থ শিক্ষিত মানুষ। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দেশে যখন হাজার হাজার লোক মৃত্যুবরণ করছিল, তখন মৃতের পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা চলত। এ অবস্থা দেখে কবি নজরুল তার 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' কবিতায় তখন সাম্প্রদায়িক বিভেদের তীব্র প্রতিবাদ করেন এভাবে [দেখুন, নজরুল রচনাবলি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২২] :
'হিন্দু না ওরা মুসলিম?' ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র!
হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়ে নয়, কবি নজরুল মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। এটিই যথার্থ মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যাশিক্ষা থেকে অনুরূপ মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে না পারলে একজন ডিগ্রিধারীকে শিক্ষিত বলা যায় না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে। তার মূল কথাটি হচ্ছে রাষ্ট্র একই পদ্ধতির, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সকল শিশুর জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। একই সঙ্গে শিক্ষাকে সমাজের চাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং ওইসব চাহিদা পূরণে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রেষিত নাগরিক তৈরি করতে হবে।
আমাদের দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনটি প্রধান ধারা রয়েছে- সাধারণ শিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা। ধারণা করা হয় যে, সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের বড় অংশ মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ বলে মনে করে। অন্যদিকে, ইংরেজি মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের উলেল্গখযোগ্য অংশ সমাজের বিত্তবান শ্রেণির সন্তান বলে মনে করা হয়। যাদের অনেকেই বিদেশে যাওয়ার আশায় উদগ্রীব থাকে বিধায় বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-কৃষ্টি ইত্যাদির ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন থাকে। আর মাদ্রাসায় মূলত গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে। সেখানে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান কমই শেখানো হয়। এই তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের দেশে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার পথে অন্যতম বাধা।
উপরোক্ত তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় এ বিষয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন আজ সময়ের দাবি। উলেল্গখ্য, সংবিধানের উক্ত অনুচ্ছেদের নির্দেশনাকে অনুসরণ করেই বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশন ('খুদা কমিশন') তাদের রিপোর্টে 'প্রাথমিক শিক্ষা' সম্পর্কে সুপারিশ করেছিল : 'সমগ্র দেশে সরকারি ব্যয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত একই মৌলিক পাঠ্যসূচিভিত্তিক এক এবং অভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করতে হবে।'
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর শিক্ষাস্তর পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ-পদোন্নতিতে বিরাজ করছে অনিয়ম। অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয় না। এখন শিক্ষকরা নিজেরাই যদি ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হন, তাহলে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের নীতি-নৈতিকতা, সত্যবাদিতা, সমাজের অন্য দশজনকে ভালোবাসা, দেশপ্রেমবোধ ইত্যাদি শিক্ষা দেবেন কীভাবে?
আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মানুষ। পৃথিবীর সকল মানুষের গায়ের চামড়ার নিচে একই লাল রক্তের প্রবহমানতা ছাড়াও মানুষের মধ্যে আর একটি বড় মিল হচ্ছে, মানুষ সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী, যার কারণে মানুষ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে নিজের প্রয়োজন মতো সাজিয়ে নিতে পারে। আমাদের দ্বিতীয় পরিচয়, জাতি হিসেবে বাঙালি। আমরা এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা, হাজার বছর ধরে এখানেই বসবাস করে আসছি, বাংলায় কথা বলি (অবশ্য আদিবাসীরা বাদে), মাছ-ভাত খাই এবং একই ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। নাগরিকত্ব হচ্ছে আমাদের তৃতীয় পরিচয়। নাগরিকত্ব সূত্রে, ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদের পূর্ব পুরুষদের পরিচয় ছিল 'ভারতীয়'; ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর আমরা হয়ে গেলাম 'পাকিস্তানি'; এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা হয়ে গেলাম 'বাংলাদেশি'। একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয় যে, নাগরিকত্ব সূত্রে যে পরিচয়, তা রাষ্ট্রীয় পরিচয় পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তনশীল, কিন্তু জাতীয়তা অপরিবর্তনশীল। তাই আমরা এই অঞ্চলের বাসিন্দারা বরাবরই বাঙালি ছিলাম এবং আছি। ধর্মীয় বিশ্বাস হতে পারে মানুষের চতুর্থ পরিচয়। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক পরিচয়ও পরিবর্তনশীল, কারণ মানুষ ধর্মান্তরিতও হয়। এ ছাড়া, মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে একটি শিশুর কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস থাকে না; তখন তার একমাত্র পরিচয় থাকে সে একটি মানব সন্তান।
উপরে উলিল্গখিত চার ধরনের পরিচয় নিয়ে শিক্ষক সমাজের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকা অস্বাভাবিক নয়, কারণ তারা এই বিভ্রান্ত সমাজেরই বাসিন্দা। আর জাতীয় পরিচয় বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজেরা বিভ্রান্ত থাকলে শিক্ষকদের পক্ষে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ বা দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে চলমান নারী-শিশু ধর্ষণ, খুন, রাজনৈতিক পরিচয়ে সন্ত্রাস, সরকারি কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতি বা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কর্তৃক যে কোনো ছল-ছুতোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি অন্যায়-অনৈতিক ঘটনাবলি দেখে-শুনেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে। এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের নীতি-নৈতিকতা, সত্যবাদিতা, মানবিকতা, দেশপ্রেমবোধ ইত্যাদি শিক্ষা দেবেন কীভাবে?
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন