- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- আমাদের আস্থার নাম সমকাল
আমাদের আস্থার নাম সমকাল

সমকালের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেছিলেন, অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে এগিয়ে যাবে পত্রিকাটি। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে অকস্মাৎ হারিয়ে শুধু সমকাল নয়, দেশের গোটা সংবাদমাধ্যম জগৎই বিশাল এক শূন্যতার সম্মুখীন হয়েছিল। সেই শূন্যতা হয়তো পূরণ হওয়ার নয়। ২০১৯ সালে তুলনামূলক তরুণ সম্পাদক হিসেবে মুস্তাফিজ শফি কি ভেবেছিলেন যে, ২০২০ সালে এসে গোটা পৃথিবীর মতো সমকাল পত্রিকাটি করোনাভাইরাসের মহামারিতে নজিরবিহীন বাস্তবতার সম্মুখীন হবে?
আমরা কেউই ভাবিনি ২০২০ সাল এতটা অনিশ্চয়তা আর চ্যালেঞ্জের বছর হয়ে আমাদের জীবনে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে জায়গা করে নেবে। ১৬তম বছরে পদার্পণ করে সমকাল আমাদের কাছ থেকে কী আশা করে? পাঠক, সমালোচক হিসেবে আমরা কী আশা করি সমকালের কাছে? করোনাকালে সমকালকে আমাদের বিশেষ অভিনন্দন দেওয়া উচিত। করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সগৌরবে টিকে আছে সমকাল। এ জন্য দৈনিক সমকাল পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক, সম্পাদনা পর্ষদ এবং সংশ্নিষ্ট সব সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মীকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন। সমকাল সচল আছে, এগিয়ে যাবে দুরন্ত সাহস নিয়ে, এই বিশ্বাস আমাদের আছে।
সচল থাকাটাই একমাত্র গৌরবের কারণ হতে পারে না। সমকাল সচল আছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আর মানুষের আস্থা নিয়ে। ১৬ বছর ধরে সমকাল নিজস্বতা প্রমাণ করে চলেছে পৃষ্ঠাসজ্জা থেকে শুরু করে যৌক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে। নিরপেক্ষতার ভান করে ইতিহাস, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়নি সংবাদপত্রটি। সবচেয়ে বড় প্রমাণ বোধ করি ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারে সমকালের স্পষ্ট অবস্থান। সেই অবস্থান শুধু স্পষ্টতার স্বাক্ষর বহন করেনি, সমকাল বরং দেশবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিল সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা কেমন হওয়া উচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়নি প্রথম রায়ে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাই ক্ষুব্ধ, ব্যথিত। কিন্তু আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে? সাধারণ মানুষ ভেতরে ভেতরে কতটা ফুঁসে উঠেছিল সেটি তো শাহবাগের গণজাগরণ দেখেই আমরা সম্যক ধারণা করতে পারি। জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে সে সময় সমকাল লিখেছিল, 'এই রায় মানি না'। শীর্ষ সংবাদ প্রকাশ করে দেশবাসীকে সেদিন পথ দেখিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার। সমকালের এই ঐতিহাসিক ভূমিকার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকার তুলনা তাই যথোচিত। বস্তুনিষ্ঠতা আর দায়িত্বশীলতার চমৎকার মিশেলে সমকাল স্বীয় মহিমায় উদ্ভাসিত। সমকাল পত্রিকার কষ্টার্জিত এই মহিমা দিন দিন আরও আলো অর্জন করুক।
২০২০ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য বছর হিসেবে লেখা থাকবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছে জাতি। স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবময় প্রক্রিয়ায় জাতির অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল সংবাদমাধ্যম। স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার পথে সংবাদমাধ্যমের গঠনমূলক ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোর একাংশের আত্মঘাতী তৎপরতায় জাতীয় জীবনে সৃষ্ট ধোঁয়াশাচ্ছন্ন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে দেশি-বিদেশি চক্র। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন কিন্তু দায়িত্বশীল গণমাধ্যম চাইতেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, 'বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। শোষকদের আর বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। কোনো ভুঁঁড়িওয়ালা এ দেশে সম্পদ লুটতে পারবে না। গরিব হবে এই রাষ্ট্র এবং এই সম্পদের মালিক শোষকরা হবে না। এই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ থাকবে না। এই রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র- 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।' বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য কাগজকে আমি মতামত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার দিয়েছি।'
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণ প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :'বিপ্লবের পরে কোনো দেশ কোনো যুগে এতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে নাই, যা আমরা করছি। আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করি। এ জন্য আপনাদের কোনো কাজে কখনও কোনো রকম হস্তক্ষেপ করি নাই।
সমকাল স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জঙ্গিবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার দৈত্যকে বধ করে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নজিরবিহীন অর্জনে শেখ হাসিনার সরকারকে বাহবা দিচ্ছে পুরো বিশ্ব। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে আরও বেশি সাফল্য দেখাতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নির্বাহী, বিচার ও সংসদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদমাধ্যমের গঠনমূলক ভূমিকা অপরিহার্য। সমকাল এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। একটা উন্নয়নমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে দৈনিক সমকাল। রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ইতিবাচক অর্জনগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে সমকাল প্রকৃত গণমাধ্যমের দায়িত্ব পালন করছে। সম্পাদকীয়, বার্তা, ফিচার প্রতিটি বিভাগেই সমকাল শক্তিশালী সংবাদপত্র হয়ে পাঠক ও নীতিনির্ধারকদের বাতিঘর হয়ে কাজ করছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
সমকাল এখন দেশের মানুষের সপক্ষের সংবাদপত্র। প্রচার সংখ্যায় হয়তো শীর্ষে নয়; কিন্তু গুণগত দিক থেকে সমকালকে সামনে রাখতেই হবে। সমকাল তাই শুধু চোখের আরাম নয়, বোধেরও আরাম হয়ে এভাবেই আমাদের সামনে হাজির হোক প্রতিদিন। শুধু মুদ্রণ মাধ্যম নয়, অনলাইন, ই-পেপার, ফেসবুক পেজ, ইউটিউবে সমকাল হয়ে উঠুক সমান আস্থা ও প্রিয়তার নাম।
সভাপতি, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন