ষাট এবং সত্তরের দশকে আমাদের কৃষির অবস্থা কেমন ছিল? ভাবতে গেলে খুবই একটা দীনদশা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঘরে ঘরে ছিল ভাতের অভাব। একজন শ্রমিক সারাদিন কাজ করে যে মজুরি পেতেন তাতে তিন কেজি চাল কেনারও সামর্থ্য হতো না। এখন আর সেই অভাবের দিন নেই। যে কৃষক আগে খাদ্যঘাটতিতে ছিলেন, তিনি এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল তিন কেজি চালের সমান মজুরি, তিনি এখন কাজ করেন ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক- কারোই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই।
প্রতি বছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে আট লাখ হেক্টর। এরপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের; বরং বাড়ছে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপখাতে। এর পেছনে প্রধান সহায়ক শক্তি নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব নীতি। একই সঙ্গে আমাদের অদম্য কৃষকের কথা স্মরণ করতে হবে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে।
বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কৃষি খাতকে। রাসায়নিক সারের দাম দফায় দফায় কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। গত এক যুগে শুধু সারেই ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। পানি সেচের জন্য ব্যবহূত বিদ্যুতের ওপর চালু করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভর্তুকি। ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যের বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি। মোট বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে কৃষি ভর্তুকির খাতে। তা ছাড়া দ্রুত হ্রাস করা হয়েছে কৃষি ঋণের সুদের হার। তাতে কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির ধারণ ও বিকাশ উৎসাহিত হয়েছে। পানি সেচের আওতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মোট আবাদি জমির প্রায় ৭০ শতাংশ। উচ্চ ফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানিজমি। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। ২০০৮-০৯ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩৩৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ সালে তা ৪২০ লাখ টনে বৃদ্ধি পায়।
চিরকালের খাদ্যঘাটতির দেশ পরিণত হয়েছে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে। বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করেছে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে। বাংলাদেশের ফসলের মাঠ এখন সবুজ শস্য ও সোনালি ধানে-গমে-ভুট্টায় ভরে থাকে। এক অভাবনীয় চোখ জুড়ানো উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এ দেশের কৃষি খাতে। খাদ্যশস্য খাতে এখন গড় প্রবৃদ্ধির হার বছরে ৩.৫ শতাংশ। বিশ্বের চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
খাদ্যশস্যের আরেকটি বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে সবজি উৎপাদনে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে বিদায়ী বছর (২০১৯-২০ সাল) পর্যন্ত সবজি উৎপাদন প্রতি বছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও ভারতের পর বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মৌসুমের শুরুতে বাজারে সবজির দাম ভালো থাকায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি সম্প্রসারিত হওয়ায় দেশের কৃষকরা সবজি চাষে বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন আধুনিক সবজি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্বীয় উদ্যোগে তারা গড়ে তুলেছে বড় সবজি খামার। এর উৎপাদনে সময় কম লাগে। গ্রামের কৃষকরা বাড়ির আঙিনায়, প্রান্তিক জমিতে এবং ফল বাগানের সাথি ফসল হিসেবেও সবজি চাষ করতে পারে। এর অনেক নতুন প্রযুক্তিও উদ্ভাবিত হয়েছে গবেষণার মাধ্যমে। অদূর ভবিষ্যতে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের বর্তমান ঘাটতি পুরোপুরি মেটানো যাবে বলে আশা করা যায়।
সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ফল উৎপাদনে। বর্তমানে এ দেশে ফলের উৎপাদন প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টন। ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। দুই দশক ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে ১১ শতাংশের ওপরে। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। মানুষ আপেলের পরিবর্তে বেশি করে খাচ্ছে কাজি পেয়ারা। তাতে বিদেশি ফলে আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সাশ্রয় হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এ দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন। ২০১৯-২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ টনে। মৎস্য খাতে বর্তমান গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। হিমায়িত খাদ্য ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে প্রতি বছর আমাদের আয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইলিশের উৎপাদনে সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো। সরকারের মা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। দেশ এখন মাংসের উৎপাদনেও স্বয়ম্ভর। ডিম ও দুগ্ধ উৎপাদনে এখনও ঘাটতি আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে যে হারে উৎপাদন বাড়ছে তাতে এ দুটো পণ্যেরও ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে অচিরেই।
কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। ভূমি কর্ষণ, আগাছা পরিস্কার, ফসল কর্তন ও মাড়াই, ধানভানাসহ সব ক্ষেত্রেই এখন কায়িক শ্রমের ব্যবহার সীমিত হয়ে এসেছে। বেড়েছে যন্ত্রের ব্যবহার। একসময় ভূমি কর্ষণের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন করা হতো লাঙল দিয়ে। ব্যবহার করা হতো পশুশক্তি। এখন পশুশক্তির ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশই যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাষাবাদ চলছে। বর্তমানে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। হাওর ও পার্বত্য এলাকায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার আরও দ্রুত সম্প্রসারিত করা দরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অতি সম্প্রতি তিন হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয়েছে একটি কৃষি যন্ত্রায়ন প্রকল্প। আশা করা যায়, তাতে কৃষি যন্ত্রায়নের সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত হবে। যে কোনো কৃষক তার প্রয়োজন অনুসারে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।
কৃষিপণ্যের মূল্যে স্থিতিশীলতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের বেশ সাফল্য আছে। গত ১২ বছরে কোনো কৃষিপণ্যেরই দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়নি, কিংবা একদমই নিচে নেমে গিয়ে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। তা ছাড়া, কৃষিপণ্যের অঞ্চলভিত্তিক মূল্যপার্থক্য ছিল কম। পেঁয়াজের সাময়িক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি ব্যতিক্রম। গত মৌসুমে বোরো ধানের বাজারদর ছিল ভালো। আমদানিকৃত চালের ওপর শুল্ক্ক কমানো আছে ২৮ শতাংশ। তাতে চালের অভ্যন্তরীণ বাজারে ছিল তেজিভাব। কোথাও কোনো দরপতন বা লোকসানের খবর শোনা যাচ্ছে না কৃষকদের পক্ষ থেকে। পাটের বাজারদরও ভালো। এটি সরকারি নীতিরই সুফল।
গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে আমাদের কৃষকরা। তারা মানুষের ক্ষুধার নিবারণ করছে। তাই দেশের কৃষকদের আমাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত। তাদের সম্মান দেওয়া উচিত। এ বিষয়টি আমাদের জাতীয় কৃষিনীতিতে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকা দরকার। আমরা কি প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারছি?
কৃষি অর্থনীতিবিদ

বিষয় : কৃষকের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারছি?

মন্তব্য করুন