রোববার রাতে ধানমণ্ডি এলাকার সড়কে একটি গাড়ি অপর একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় যা ঘটেছে, তা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার নিকট-অতীতে নজিরবিহীন। রাজধানী ঢাকার যানজটকবলিত রাজপথে 'দাপট' দেখাতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনা, রক্তপাত, এমনকি প্রাণহানির মতো অঘটনও আমরা কম দেখি না। কিন্তু এর বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত প্রতিকারহীন রয়ে যায়। প্রাথমিক থানা-পুলিশি প্রক্রিয়ার পর হারিয়ে যায় আরও 'বড়' ঘটনার ঘনঘটায়। বিশেষত দুর্ঘটনার জন্য দায়ীপক্ষ যদি হয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী। রোববারের অঘটনেও আমরা দেখেছি, ধাক্কা দেওয়া গাড়িটি ছিল সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত। তারা কেবল ধাক্কা মেরেই ক্ষান্ত হয়নি; সঙ্গত প্রতিবাদ করতে গেলে সস্ত্রীক মোটরসাইকেল আরোহী ব্যক্তিকে অকথ্য গালাগাল ও নির্বিচার মারধর করেছে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গাড়িটি ঢাকা-৭ আসনের বহুল আলোচিত সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের। তিনি নিজে গাড়িতে না থাকলেও তার ছেলে ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ছিলেন। সঙ্গে ছিল তার দেহরক্ষীসহ আরও কয়েকজন কর্মচারী। প্রত্যক্ষদর্শীদের শঙ্কা, দায়িত্বরত পুলিশসহ পথচারীরা এগিয়ে না গেলে আঘাতকারীদের 'ক্ষমতা প্রদর্শন' আরও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারত। বলাবাহুল্য, এমন চিত্রও আমাদের রাজপথে বিরল নয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার কর্মকর্তা। মারধরের শিকার ওই কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খান রক্তাক্ত মুখে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন- এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। বস্তুত তিনি নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও গাড়ি আরোহীরা তার ওপর যেভাবে চড়াও হয়েছে, তাতে অভিযুক্তদের বেপরোয়া মনোভাবই স্পষ্ট হয়। আমরা দেখেছি, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় সাংসদ হাজী সেলিমের বাসায় র্যাব অভিযান চালিয়ে সাংসদপুত্রকে অস্ত্র, মাদক ও অননুমোদিত ওয়াকিটকিসহ আটক করে। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ইরফান সেলিমকে মাদক সেবনের জন্য এক বছর ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার জন্য ছয় মাস- মোট দেড় বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার দেহরক্ষীকেও দেওয়া হয় ছয় মাস কারাদণ্ড। ইতোমধ্যে সাংসদপুত্রের আলোচ্য গাড়ির চালক ও অন্যতম আরোহী 'প্রটোকল' কর্মকর্তাও আটক হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। আমাদের এই প্রত্যাশা অমূলক হতে পারে না যে, বাদী নৌবাহিনী কর্মকর্তা উপযুক্ত প্রতিকার পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সোমবার বলেছিলেন- সমাজের যে শ্রেণির মানুষই অপরাধ করুক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরাও চাই, আইন চলুক নিজস্ব গতিতে। স্বল্পতম সময়ে গাড়িটি জব্দ, থানায় মামলা, অভিযান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোষী ব্যক্তিদের দণ্ড প্রদান- সাধারণ বিচারপ্রার্থীর ক্ষেত্রেও আমরা প্রত্যাশা করি এমন তৎপরতা। বস্তুত সেটাই আইনের শাসনের প্রত্যাশিত রূপ। বিবাদী ও বাদী যেই হোক না কেন, প্রত্যেকেরই রয়েছে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার। প্রত্যেকেরই পাওয়া চাই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ। আমরা প্রত্যাশা করি, আলোচ্য ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক। প্রতিকার বা বিচারপ্রার্থী যে কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রেই পুলিশ ও র্যাব এমন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। তাতে একদিকে যেমন বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে ফিরবে না; অন্যদিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরাও 'ক্ষমতা' প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করবে না। মনে রাখতে হবে, সীমা লঙ্ঘনকারীকে কেউ পছন্দ করে না। দশ দিন পার পেয়ে গেলেও এক দিন বিপাকে পড়তেই হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে অর্থনৈতিকভাবে আমরা যখন উন্নত বিশ্বের কাতারে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি; তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও তার প্রয়োগেও হতে হবে উন্নত। আইনকে চলতে দিতে হবে নিজের মতো।
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০ । ০০:০০ । প্রিন্ট সংস্করণ
মন্তব্য করুন