ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ২০১৬ সালে উইসকনসিন রাজ্যে সামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন; তিনি এমন ২৩টি কাউন্টি নিজের পক্ষে নিতে পেরেছিলেন, যেগুলো আগের নির্বাচনে ছিল বারাক ওবামার ঝুলিতে। বুধবারের নির্বাচনী ফলে দেখা যাচ্ছে, জো বাইডেন সেখান থেকে মাত্র দুটি কাউন্টি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন- ডোর ও সাউক। ওবামা-ট্রাম্প কাউন্টিগুলোর কাড়াকাড়িতে যাওয়ার বদলে বাইডেন বরং উইসকনসিনের দুই বৃহৎ শহর মিলওয়াকি ও মেডিসোনে ভোটের ব্যবধান আগের তুলনায় বাড়িয়ে নিয়েছেন। একই ফর্মুলা দেখা যাচ্ছে মিশিগান ও অন্যান্য লড়াইমুখর রাজ্যে। জো বাইডেন শহর ও উপকণ্ঠে ডেমোক্র্যাট ভোট বাড়িয়েছেন; কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রামীণ আমেরিকাকে আরও লাল করে তুলেছেন।
২০২০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে শহর-গ্রামের বহুল আলোচিত বিভক্তি আরও গভীর হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বিভক্তি আমেরিকার জনগণের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অনৈক্য আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। এর মধ্যে রয়েছে কীভাবে করোনাভাইরাস অতিমারি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বা আদৌ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত কিনা। কীভাবে অর্থনীতিতে পুনরায় গতি আনা যাবে এবং কর্মসংস্থানের পুনর্ব্যবস্থা হবে। কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা হবে বা এটা মোকাবিলা আদৌ জরুরি কি-না। রাজনীতিতে নৈতিকতা, সহমর্মিতা, আইনের শাসনের আদৌ ভূমিকা রাখা উচিত কিনা।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পপুলার ভোট ও ইলেক্টোরাল কলেজের প্রবণতা অনুযায়ী জো বাইডেনই যদি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হন, তাকে একটি তিক্ততার সঙ্গে বিভক্ত দেশের দায়িত্ব নিতে হবে। বস্তুত রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছেন; দলটির বিপুল সংখ্যক ভোটার যে তা সমর্থন করেছেন- এই নির্বাচনে স্পষ্ট। রিপাবলিকান পার্টি সিনেটে সামান্য ব্যবধানে হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকছে এবং কংগ্রেসে নিজেদের আসন বাড়িয়ে নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সীমা আরও কৃশকায় করে তুলেছে। এ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে দুই দলের যুযুধান সময়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যে কোনো সংকটেই তা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। খোদ জো বাইডেনও বুধবার স্বীকার করেছেন, তিনি এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।
কোনো কোনো ডেমোক্র্যাট নেতা বিশ্বাস করেন, অতিমারি ও অর্থনৈতিক মন্দা হয়তো তাদের কিছু ভোটারকে প্রতিপক্ষের শিবিরে ঢুকিয়েছে এবং তারা আর ফিরে না আসায় লড়াইমুখর রাজ্যগুলোতে বাইডেনের জয়ের ব্যবধান সংকীর্ণ করে তুলেছে। এমনকি তিনি ফ্লোরিডা রাজ্যে ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হিলারি ক্লিনটনের চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন।
ব্রুকলিন ইনস্টিটিউটের গভর্ন্যান্স স্টাডিজ প্রোগ্রামের চেয়ারপারসন উইলিয়াম এ গলস্টেন মনে করেন, লাল-নীলের বিভক্তি ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ক্রমে দুষ্টচক্রে ঢুকে যাচ্ছে এবং রাজনৈতিক পছন্দ ক্রমেই আর সব বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসন গত চার বছর ধরে 'বিরামহীনভাবে' যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ ভোটারদের কাছে গেছে এবং বলেছেন, প্রেসিডেন্ট কেবল তাদের স্বার্থই বোঝেন। তারাই আসল আমেরিকা। শহরগুলোতে বাইরের মানুষ এসেছে। গত চার বছরে একটি দিনও ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন কোনো বাক্য বলেননি, যা একটি ঐক্যবদ্ধ আমেরিকাকে তুলে ধরে। জো বাইডেন এই বিভক্তি নিরসন করতে সক্ষম হননি।
ডেমোক্রেটিক জনমত জরিপকারী কর্নেল বেলচার আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ভোটারদের মধ্যে 'অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা' নিয়ে অনুমান বাদ দেওয়া উচিত। এটা আসলে কুৎসিত 'গোত্রবাদ' ছাড়া আর কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রে যে অঞ্চলগুলোতে জনমিতিগত পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, সেগুলোতেই এই নির্বাচনে 'তপ্ত প্রতিযোগিতা' দেখা গেছে। ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, টেক্সাস, আরিজোনা, নেভাডা, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান রাজ্য এর উদাহরণ।
ভোটের প্রাথমিক ফলাফলেই দেখা যাচ্ছিল, গত চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম কীভাবে একটি দলকে নিজের মতো করে খেয়ে ফেলতে পেরেছেন। ট্রাম্প যখন বারাক ওবামার জন্মস্থান নিয়ে মিথ্যাচার করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন স্বেতাঙ্গ রিপাবলিকানদের অনেকে রোমাঞ্চিত হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন গত চার বছরের কেলেঙ্কারি-ভরা শাসনামলে নিজের ব্যক্তিগত স্বভাব ও বৈপরীত্য দলের নীতি হিসেবে চালাতে চেয়েছেন, সেটা রিপাবলিকান পুনরুত্থান বলে বিবেচিত হয়েছে। তার শাসনামলে দেশটির যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা রক্ষণশীল বিচারপতিদের দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হয়েছে; পরিবেশ ও অন্যান্য সুরক্ষাসংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধান উল্টে দেওয়া হয়েছে এবং বিত্তশালী ও পুঁজিপতিদের কর কমানো হয়েছে।
উপরন্তু, রিপাবলিকান পার্টি বলতে কী বোঝায়, এখন আর স্পষ্ট নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করা ছাড়া দলটির আর কোনো সাধারণ কর্মসূচি বা ঐকমত্যভিত্তিক নীতি নেই। দলটির আনুষ্ঠানিক দপ্তর এখন 'ব্রিফ রেজুলেশন' ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করে না; সংবাদমাধ্যমের প্রতি নিম্নশ্রেণির আক্রমণ এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচ্চ প্রশংসা ছাড়া সেখানে আর কিছু থাকে না।
নেতৃস্থানীয় কিছু রিপাবলিকান এখনও টিকে আছেন। তারা মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভেদমূলক রাজনীতি দলটির জন্য সামনের নির্বাচনগুলো আরও কঠিন করে তুলবে। কিন্তু নিজেদের তৈরি করা দৈত্যের কাছ থেকে দলটিকে সরিয়ে আনাও এখন চ্যালেঞ্জ। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সরেও যান, তিনি রিপাবলিকান দলের কট্টর কর্মীদের মনস্তত্ত্বে ধ্রুবতারা হয়েই বিরাজ করবেন।

 লেখকদ্বয় ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক; ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর শেখ রোকন

বিষয় : রিপাবলিকান পার্টি গেছে ট্রাম্পের পেটে

মন্তব্য করুন