- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- মহানবী (সা.) -এর অনুসরণ
মহানবী (সা.) -এর অনুসরণ

মহানবী (সা.) হলেন গোটা মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এক মহত্তম আদর্শ। জাতি, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই তার আদর্শ উন্মুক্ত ও অবারিত; যে কেউ তাকে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুসরণ করে স্বীয় সামগ্রিক পরিমণ্ডলকে বরকতমণ্ডিত করতে পারে। মহানবী (সা.)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই, জাত-ধর্মের কোনো প্রভেদ নেই, সমাজ বা দেশের কোনো বিশেষ গণ্ডিতেও তার জীবনাদর্শ সীমাবদ্ধ নেই; বরং সমগ্র পৃথিবীর জন্যই তিনি প্রেরিত ও তার মহত্তম আদর্শও পুরো মানবজাতির জন্যই প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ তাই তার প্রিয় হাবিবকে বলেছেন, 'কুল ইয়া আইয়ুহান্নাস ইন্নি রাসুলুল্লাহি ইলাইকুম জামিআ' অর্থাৎ, হে নবী! আপনি বলে দিন, ওহে পৃথিবীর মানবসকল! মহান আল্লাহ আমাকে তোমাদের সকলের জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং আল্লাহপাকের এই সর্বজনীন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী (সা.)-কে যদি আমরা মূল্যায়ন করি তবে সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা তিরোহিত হয়ে যায় এবং তদস্থলে মানবজাতির বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির পথও প্রশস্ত হয়।
মহানবী (সা.) যেমন বিশ্বের সব মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন ঠিক তেমনি মানবজাতিরও উচিত সেই মহামানবের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান ও ভালোবাসা পোষণ করা। মহানবী (সা.)-এর অনুপম আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই তার প্রতি মানবজাতির হক আদায়ের বিষয়টি পূর্ণতা লাভ করতে পারে। আল্লাহপাক বলেছেন, 'লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ' অর্থাৎ, তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনের ভেতরেই রয়েছে অনুকরণীয় মহত্তম আদর্শ। তাই মানবজীবনের পার্থিব ও অপার্থিব সাফল্য লাভের প্রধান নিয়ামক হলো মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শের অনুসরণ করা। আর তার আদর্শকে অনুসরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় আমাদের মানসপটে জাগরূক রাখতে হবে; সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সুন্নাতে রাসুল, আযমাতে রাসুল, হুব্বে রাসুল ও ইত্তেবায়ে রাসুল (সা.)।
বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে সোয়া লাখ সাহাবায়ে কেরামের জনসমুদ্রে মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছিলেন, 'তারাকতু ফিকুম আমরাইন লানতাদিল্লু মা তামাস্সাকতুম বিহিমা কিতাবাল্লাহি ওয়া সুন্নাতা রাসুলিহি' অর্থাৎ, আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটিকে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কোনো ধরনের পথভ্রষ্টতা তোমাদের স্পর্শ করতে পারবে না; একটি হলো আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি হলো তার রাসুলের সুন্নাত। সুতরাং আমাদের সামগ্রিক কামিয়াবির জন্য সুন্নাতে রাসুলকে আমাদের জীবনবোধে একাকার করে নিতে হবে। আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে রাসুলের সুন্নাতকে অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে থাকতে হবে। পবিত্র কোরআনে ১৬ বার সুন্নাত শব্দটির ব্যবহার হয়েছে; রাসুল (সা.)-এর সামগ্রিক জীবনকে পরিচালনার যে সংবিধিবদ্ধ রীতি-পদ্ধতি রয়েছে, তাই সুন্নাত হিসেবে বিবেচিত। রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের জন্য আমার ও আমার সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাত পালন আবশ্যক। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ, 'আতিউল্লাহা ওয়া আতিউর রাসুল' অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো। এখানে রাসুলের আনুগত্য মানেই হলো সুন্নাতে রাসুলকে অনুসরণ করা। জীবন পরিচালনার সব ক্ষেত্রে রাসুলের দেওয়া সিদ্ধান্ত বিনা শর্তে মেনে নেওয়া ইসলামী বিশ্বাসের অন্যতম অঙ্গ; সুরা নিসার ৬৫ নম্বর আয়াতের সারমর্ম হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষকেই উদ্ভূত সব পরিস্থিতিতে রাসুল-প্রদত্ত ফয়সালাকে যতক্ষণ মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি না হবে, ততক্ষণ সে ইমানদার হিসেবে পরিগণিত হবে না। মানবজীবনের নানা বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর দেওয়া রীতি-পদ্ধতি ও নির্দেশনাই সর্বাধিক মানবহিতৈষী; তাই আমাদের উচিত তার সুন্নাতের অনুসরণের মধ্য দিয়ে মানবিক ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা।
আযমাতে রাসুল হলো রাসুলে পাকের শান, মান, মাকাম, সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা। আল্লাহপাকের বাণী, 'ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু য়ুসাল্লুনা আলান্নাবিয়ি্য' অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাকুল মহানবী (সা.)-এর ওপর সালাম ও দুরুদ পাঠ করেন। এ আয়াতের মাধ্যমে রাসুলের সর্বোন্নত মর্যাদা ও সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানের কথা আমরা বুঝতে পারি। মহান আল্লাহর পরেই মর্যাদার দিক থেকে কুল কায়েনাতের শিরোমণি হচ্ছেন মহানবী (সা.); তাই তাকে সর্বাবস্থায় সবারই উচিত হবে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা, তার উচ্চ মাকামের প্রতি খেয়াল রাখা এবং কোনো অবস্থাতেই তাকে হেয়প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াস না চালানো। পৃথিবীর বিরাট সংখ্যক মানুষ যেখানে সরাসরি তাকে অনুসরণ করে, ভক্তি-শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ আসনে রাখে, সেই বিবেচনায় কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর জন্য এটি সংগত নয় যে, তাকে নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করবে, ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করবে বা অন্য যে কোনো উপায়ে তার অসম্মান করবে। বরং মহানবীকে সম্মান করার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মানুষ নিজেকেই যেন সম্মানিত করে, তাকে অপমানের মধ্য দিয়ে গোটা মানবজাতি ও মানবসভ্যতাকেই অপমান করা হয়। যার ফলে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম নেয় এবং বিরাট সংখ্যক মানুষের হৃদয়-গভীরে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয়; সেই তীব্র মানসিক ক্ষত থেকে নানা অঘটনও ঘটে। তাই বিশ্বশান্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তার স্বার্থেই রাসুলের আযমত মেনে চলা জরুরি।
রাসুল (সা.)-কে অনুসরণের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো হুব্বে রাসুল তথা রাসুলের মহব্বত বা ভালোবাসা। রাসুলেপাকের বাণী, তোমরা ততক্ষণ ইমানদার বলে পরিগণিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের সন্তান-সন্তুতি, পিতামাতা ও সব মানুষের চাইতেও আমাকে অধিক ভালো না বাসবে। তাই রাসুলের প্রতি সর্বোচ্চ অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষণ করতে হবে। সুন্নাতে রাসুল ও আযমাতে রাসুল আমরা অর্জন করতে পারব যদি সঠিকভাবে ইত্তেবায়ে রাসুল মেনে চলতে পারি। আল্লাহপাকের বাণী, 'ইন কুন্তুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিউনি য়ুহবিবকুমুল্লাহা' অর্থাৎ, যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও তবে আমাকে অনুসরণ করো, তবেই মহান আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন; আমরা সন্দেহাতীতভাবে প্রিয় রাসুলকে অনুসরণের মধ্য দিয়ে পরম রবের ভালোবাসা অর্জনে প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চাই- এটিই আমাদের আরাধ্য।
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন