পাবনা-সিরাজগঞ্জে, যমুনার চরে ১৯৪০ সালের অক্টোবরের ৩০ তারিখে জন্ম। ষাটের দশকে রংপুরে আসেন সিঅ্যান্ডবিতে চাকরি সূত্রে। নতুন জায়গায় এসে ভাই ভাষা মতিনের কথায় দেখা করতে যান ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সাথে। সিঅ্যান্ডবিতে চাকরি করেন শুনে বিখ্যাত হাস্যরসের মধ্যে সিঅ্যান্ডবির পূর্ণ রূপ তিনি করেন- 'চোর অ্যান্ড বাটপার ডিপার্টমেন্ট'। এই কথাই পাল্টে দেয় শফিউদ্দিন সরকারকে। যমুনার চরের কৃষকের জেদ নিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা সাহিত্যে। গড়ে তোলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পেশাজীবী সংগঠন 'ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স'। তাদের উচ্চশিক্ষার বাধা দূর করা, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট খোলা, শ্রেণি বা গেজেটেড প্রথা তুলে দেওয়াসহ ছয় দফা দাবিতে তাদের সংগঠিত করেন। প্রকাশ করেন 'কারিগর' নামে একটি নিয়মিত পত্রিকা। নিজস্ব ভবনের জন্য কাকরাইলের জমিটা সংগ্রহ করেন তিনি। সেই তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, তার জীবন সাধনা ব্যর্থ। কারণ হিসেবে বলতেন, তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জীবনে ২০ ভাগ কাজ দেশের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে করতে ওয়াদা করিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কথা রাখে না।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে সাহাবুদ্দীন সরকারের আমল পর্যন্ত প্রায় সবগুলো পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি যখনই কোনো কমিশনের সদস্য হতেন, তখনই কমিশনে বাড়ি থেকে গাড়িভর্তি বই নিয়ে যেতেন, দিনরাত ওখানে পড়ে থাকতেন। তিনি প্রতিদিন খেটেখুটে যে প্রতিবেদনগুলো তৈরি করতেন, তা কতখানি গুরুত্ব পেত সন্দেহ। তিনি সবসময়ের জন্য হাতেকলমে দেখিয়ে দিতেন, কীভাবে স্বল্প খরচে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হয়।
কীভাবে স্থানীয় গ্রিড গড়ে তুলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা যায়, যশোর-খুলনা অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে আট কোটি টাকার কাজ কীভাবে ২৩৭ কোটি টাকায় শেষ করা হচ্ছে। ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে দৃষ্টি ফেরান সিএস ম্যাপের দিকে- এসব তিনি বলতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্বার সড়কের বদলে নৌ ও রেলপথকে অধিক গুরুত্ব দিতে বলেছেন। আজকের যে তিস্তা ব্যারাজ, সেটিকে তিনি কাউনিয়ার রেলসেতু থেকে আরও নিচে করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কালের যাত্রায় তার কথাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
সরকার ভাই প্রায়ই বলতেন, আমাদের সব রাজনীতিবিদের পরিণতি দেবী চৌধুরাণী। দেবী চৌধুরাণী, যার ডাক নাম প্রফুল্ল। স্বামী ব্রজেশ্বর বাবার কথায় তাকে ফেলে যান। নানান ঘটনায় তার সঙ্গে দেখা হয়, ব্রিটিশবিরোধী বীর ভবানী পাঠকের। তার কাছে পাঁচ বছর কঠোর সাধনায় দীক্ষাপ্রাপ্ত হন তিনি। তারপর কুখ্যাত কালেক্টরেট গুডলাক ও জমিদার দেবীরায়ের বিরুদ্ধে যেই যুদ্ধে নামবেন, তখনই হঠাৎ দেখা সেই ফেলে রেখে যাওয়া স্বামী ব্রজেশ্বরের সঙ্গে। ইতোমধ্যে ব্রজেশ্বর আরও দুটি বিয়ে করেছেন। কিন্তু দেবী চৌধুরাণী ওরফে প্রফুল্ল সব ভুলে স্বামীর বাহুডোরেই মুক্তি খুঁজে পেলেন। শফিউদ্দিন সরকার ভাই বলতেন, আমাদের রাজনীতিবিদগণও তাই। জীবনের সকল সাধনা স্বজনপ্রীতিতে গিয়ে শেষ হয়।
সম্ভবত ২০০৩ সাল, জানুয়ারি মাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম, ম ইনামুল হকের সঙ্গে দীপালি ও আমাকে নিয়ে উয়ারী বটেশ্বর যান। ওখানেই হাবীবুলল্গাহ পাঠান সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তার সব কাজে তরুণদের যুক্ত করতেন। তার সাধনা তরুণদের মধ্যে ছড়াতে সচেষ্ট থাকতেন। তরুণদের গড়ে তোলা তার অন্যতম সাধনা ছিল। এমন বন্ধু-অভিভাবক সহজে মেলে না। ২৫ অক্টোবর তিনিও চলে গেলেন।
সাবেক সভাপতি, রেল- নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি
nahidknowledge@gmail.com

বিষয় : একজন প্রত্যাখ্যাত প্রতিবেদক

মন্তব্য করুন