
আমরা অনেকটাই কুয়োর ব্যাঙ। যাদের কাছে ওই কুয়োটাই দুনিয়া। ফলে যখনই কুয়োর বাইরের কেউ কোনো কথা বলতে চায়, সেটাই আমাদের কাছে ভিন গ্রহের প্রাণীর কথার মতো শোনায়; অর্থহীন ও বিপজ্জনক মনে হয়। যদি সমাজটাকে পাল্টাতে চাও, তাহলে পুরোনো সমাজটাকে ভেঙে ফেলতে হবে- এমনটা যে-ই বলবেন, তাকেই আমরা বিপজ্জনক বলে তাৎক্ষণিকভাবে আখ্যায়িত করতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করব না।
বর্তমান যুগটা ক্যাপিটালিজমের যুগ। এখানে সবচেয়ে প্রধান বিষয়টি হলো এক্সট্র্যাকশন। গোটা ক্যাপিটালিজমের ইতিহাসটাই দাঁড়িয়ে আছে এক্সট্র্যাকশনের ওপর, কোনো দাম না দিয়েই প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের ওপর। কয়লা, লোহা প্রকৃতি থেকে উত্তোলন করেই শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। কয়লা, লোহা, স্বর্ণ, তেল, গ্যাস এসব উত্তোলন করে শান্ত হয়নি ক্যাপিটালিজম; এখন ফেসবুক জাতীয় কারিগরি ক্যাপিটালিজম আমাদের মনোযোগ উত্তোলন করছে আমাদের মগজ থেকে। ফেসবুক কিংবা ইন্টারনেট আমাদের জন্য যে ভার্চুয়াল দুনিয়াটা তৈরি করে দিয়েছে, তাতে আরও বেশি সময় কাটাতে এবং আরও বেশি মনোযোগ খরচ করতে বাধ্য করেছে। এই নতুন ধরনের ক্যাপিটালিজমের মূল পণ্যই হলো আমাদের মনোযোগ। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ এরা আমাদের মনোযোগের নিশ্চয়তা বিক্রি করে। কারণ বিজ্ঞাপনদাতারা গ্যারান্টি পায়- এই মনোযোগের মধ্যে আমাদের যা দেখাবে, আমরা সেটাতেই বিশ্বাস করব, সেটাই কিনব। ঘৃণা-বিদ্বেষ যেমন কিনব, আবার অন্যদিকে চিপসও কিনব। এই মনোযোগ উত্তোলনের যন্ত্রপাতি আমরা সোশ্যাল মিডিয়াকে দিয়েছি। নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ, লজ্জা-ঘৃণা-রাগের কথা জানিয়ে তাদের সুযোগ করে দিয়েছি আমাদের ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করতে। ফলে ওরা জানে, ঠিক কোথায় আমাদের মনোযোগ পাওয়া যাবে। আমরা এই মনোযোগ উত্তোলনে কখনও বাধা দিতে পারিনি। আমরা চাইনি তেমনটা। তাই সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের করে রেখেছে গুহামানবের জনগোষ্ঠী। বিনিময়ে আমরা ওদের আমাদের মগজটাকে দিয়ে দিয়েছি। আমরা বনে গিয়েছি ওদের তৈরি করা কুয়োর ব্যাঙ।
মগজ ধোলাইয়ের এই আধুনিক কাজটি করে দেখিয়েছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। তাদের গবেষণার ফল ছিল 'ডেটা ড্রিভেন বিহেভিয়র চেঞ্জ'। এর মাধ্যমেই তারা প্রভাব খাটিয়েছিল ২০১৬ সালের আমেরিকান নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়। অন্যটি ছিল ইংল্যান্ডের ব্রেক্সিট। দুনিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এই দুটো ঘটনার পেছনে ছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ভূমিকা। তারা তাদের ভাষায় সহজ কাজই করে। যদি দেখা যায় কারও মনে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রতি ভয়, তবে নিউজফিডে বারবারই আসতে থাকবে জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে ভিডিও, অন্যদের কমেন্ট, ব্লগ ইত্যাদি। কীভাবে সন্ত্রাসবাদ দখল করে নেবে গোটা পৃথিবীটাকে, সে বিষয়ে আসতে থাকে ভুয়া তথ্যসমৃদ্ধ নিউজ। আমরা অবচেতনভাবে যা কিছু ভাবি, মনে হবে যেন অন্যরাও তাই ভাবছে। ফলে আমরা তৈরি হয়ে যাই আরও বেশি কুয়োর ব্যাঙ। কারও হাতের পুতুল- সোশ্যাল মিডিয়ার হাতের পুতুল।
রাজনীতিও যেন সেভাবেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিভাজনের দোল খাচ্ছে না বুঝেই। ধর্মীয় উগ্রবাদ দিয়ে বিভাজনের ষোলোকলা পূর্ণ হচ্ছে। ফলে গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। এই টেকনোলজি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আবার আদিম মানুষের পৃথিবীতে। সেখানে প্রত্যেকে শুধু নিজের গোষ্ঠীর প্রতি অনুগত, অন্যরা তার শত্রু। এই আনুগত্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে আমাদের সমাজে প্রবেশ করছে। গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘবদ্ধ একটি সত্তার মধ্যে মানুষ পতিত হয়ে যাচ্ছে কোনো কিছু বোঝার আগেই। গুজব ছড়াতে তাই সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠছে চ্যাম্পিয়ন। গোষ্ঠীভিত্তিক সেই গুজব দৃঢ় বিশ্বাসের শক্তি নিয়ে হাজির হচ্ছে গোষ্ঠীর লোকজনের কাছে। ধীরে ধীরে গুজবই হয়ে যাচ্ছে তাদের পথ ও পাথেয় সৃষ্টির মূল সনদ। এখান থেকে সে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। কেননা, সোশ্যাল মিডিয়া তাকে আর বের হতে দেয় না। বিক্রি হয়ে যায় তার মগজ সোশ্যাল মিডিয়ার করকমলে।
ধর্মীয় উগ্রবাদের দেশগুলো এর ফলে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের মানুষগুলো আর হিংসা-দ্বেষ-বিরাগের প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে না। মগজে ঢুকে পড়ে সব নতুন সংজ্ঞা। সেই সুযোগটাই গ্রহণ করে সোশ্যাল মিডিয়া। নতুন নতুন সংজ্ঞা ঢুকিয়ে দেয় তার উত্তোলনের জায়গাগুলোতে। তাতে তার নতুন ভাবনার জায়গাটা আরও মজবুত হয়, দৃঢ় হয়। তার মনে হয়, তার চিন্তার সঙ্গে সব মানুষেরই মিল আছে। কেননা, সে তার নিজের তৈরি করা গোষ্ঠীর মধ্যেই বন্দি হয়ে থাকে। সেই গোষ্ঠীতে সবাই তারই মতো মতবাদ পোষণ করে সব সময়। আধুনিক এই ক্যাপিটালিজমের কাছে শুধু ধর্মবিশ্বাসী দেশগুলোই নয়, বন্দি হয়ে আছে অন্য দেশগুলোও।
১৮৮০-এর দশকে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে 'স্ট্যাচু অব লিবার্টি' মূর্তিটি আমেরিকাকে উপহার দিয়েছিল ফ্রান্স। মূর্তিটির পাদদেশে খোদাই করা আছে এমা ল্যাজারাস নামে এক সমাজসেবীর লেখা কবিতা, যা বিশ্বের দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও হতভাগ্য জনগণকে আহ্বান করে এই 'স্বর্ণদুয়ার' দিয়ে প্রবেশ করে নতুন দেশে স্বাধীনতার ছত্রছায়ায় নতুন জীবন গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু সেই আমেরিকায় অভিবাসন সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় আছে বর্তমানে। ২০১৫ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেই রিপাবলিকানদের মনোনয়ন পাওয়ার অভিযান শুরু করেন মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসনকারীদের অপরাধী, মাদক কারবারি, ধর্ষক বলে চিহ্নিত করে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি এ দেশে মুসলমানদের ঢুকতে দেবেন না। ষাটের দশকে বর্ণবাদবিরোধী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের ফলে আমেরিকায় বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল। ১৯৬৫ সালের আইনে সব দেশের নাগরিকদের অভিবাসনের জন্য সমানাধিকার দেওয়া হয়েছিল। আবার ১৯৯০-এর দশকে অতি-দক্ষিণপন্থি মহলে তাদের উদার অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ধারা শক্তিশালী হতে থাকল। সব মিলিয়ে সেখানেও তৈরি হয়েছে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক মতবাদের প্রাচীরের খেলা। আমেরিকানরাও আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে কুয়োর ব্যাঙই হয়ে যাচ্ছে।
একুশ শতকের টেকনোলজি আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে পেছনে টানছে না তো? গোষ্ঠীর প্রতি অনুগত হলে বিশ্বমানবতার কী হবে? চিন্তার বিষয় অবশ্যই। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী দিনের সোশ্যাল মিডিয়া? এই আধুনিকতা কি পেছনে যাওয়ার প্রতিযোগিতা? নব্য এই ক্যাপিটালিজম কোথায় গিয়ে শেষ করবে? হারাব কি এক দিন মানবিক দুনিয়ার বিশ্ব মানবতার অমোঘ বাণী? সে এক জটিল জিজ্ঞাসা।
কলাম লেখক
ceo@ilcb.net
মন্তব্য করুন