- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- মিয়ানমারের নির্বাচন ও রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
প্রতিবেশী
মিয়ানমারের নির্বাচন ও রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

মিয়ানমারের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো রোববার। একে আমি বলব 'সিলেকটিভ' নির্বাচন। সিলেকটিভ এ অর্থে যে, সেখানকার তিন কোটি ৮০ লাখের মতো ভোটারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটের বাইরে রাখা হয়েছে। সেখানকার নির্বাচন কমিশন অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা (এনএলডি) স্পষ্ট পক্ষ হয়ে কাজ করছে। ফলে আমরা দেখেছি, জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে যেখানে এনএলডির প্রভাব কম সেখানে ভোটের ব্যবস্থা করা হয়নি। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে এই নির্বাচনের বাইরে রাখা হচ্ছে। এদের মধ্যে রোহিঙ্গারাও রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, প্রায় দেড় মিলিয়ন তথা পনেরো লাখ মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করা হয়নি। বলা চলে ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ ছিল বামার জাতির মধ্যে। বামার জাতীয়তাবাদীদের একাংশ বলছে, বামার জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে হলে কেবল বৌদ্ধই হতে হবে। বামার মিয়ানমারর সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি, যারা সেখানকার সেনা সমর্থিত গোষ্ঠী।
রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালে রাখাইনের ভোটাররা রাখাইন জাতীয়তাবাদী আরাকান ন্যাশনাল পার্টিকে নির্বাচিত করেছিল রাখাইন স্টেট পার্লামেন্টে। কিন্তু এনএলডি প্রেসিডেন্ট এটিকে আমলে না নিয়ে নিজ দলের একজনকে চিফ মিনিস্টার করেছিলেন রাখাইন রাজ্যে। কাজেই এটা বলাই যায় যে, সেখানে নির্দিষ্ট দল ও জাতির শাসন।
স্বাভাবিকভাবেই অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি পার্টিই ক্ষমতায় থাকছে। অং সান সু চি ইতোমধ্যে তার ভূমিকার কারণে বিতর্কিত। এই সেই সু চি যাকে একসময় 'গণতন্ত্রের মানসকন্যা' বলে পশ্চিমা বিশ্ব বাহবা দিয়েছিল। তার জীবন কাহিনি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বই লেখাসহ যত কাজ হয়েছে, তা ছিল বিরল। আমাদের দেশেও তাকে নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক শাসনের পর প্রত্যাশা করা হয়েছিল মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরবে; কিন্তু কার্যত তা হয়নি। সু চি সেখানকার যে সংবিধানের আওতায় ভোটে গিয়েছিলেন, কার্যত তার মাধ্যমে গণতন্ত্র ফেরার সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি। গত নির্বাচনেও যখন সু চি ভূমিধস জয় পেয়েছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করেছিলেন। সমঝোতার এই সরকারে সেনাবাহিনী এখনও ব্যাপক ক্ষমতাধর। সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারের ২৫ শতাংশ সামরিক বািহনীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে। এদিকে ৭৫ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনেরও সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে কার্যত সেখানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর প্রভাবই বহাল থাকল।
অং সান সু চির যে বাহবা আমরা দেখেছিলাম আন্তর্জাতিক বিশ্বে, রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসার পরই সেটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চির জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তার ভূমিকার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সমালোচিত হন তিনি। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক ডিগ্রি ও পদক প্রত্যাহার করে নেয়। মনে করা হয়, বার্মা- আজ যে দেশ মিয়ানমার নামে পরিচিত, সামরিকতন্ত্রের পথ থেকে বাঁক বদল করে গণতন্ত্রের দিকে নতুন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১০ সালের নভেম্বরে, কারণ সে বছরেই দীর্ঘ বন্দিত্ব শেষে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল অং সান সু চিকে। সেই সু চিই যখন আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের জবাব দেন, অপরাধ করা সত্ত্বেও তার দেশের সেনাবাহিনীকে রক্ষার চেষ্টা করেন, তখন আমরা সেই সু চিকে দেখতে পাই না। আন্তর্জাতিক আদালতে তার উপস্থিতি ও বক্তব্য তাকে দেশের ভেতরে বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় করলেও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচিত হন। বস্তুত মিয়ানমার কেবল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপরই গণহত্যা চালায়নি; বরং অনেক সংখ্যালঘু উপজাতির সঙ্গেও সমান অপরাধ করেছে।
মিয়ানমারে সামরিক শাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশটি প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র্র ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলো সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সে কারণে এ নির্বাচনের ফল ত্রুটিপূর্ণভাবে ডিজাইন করা। সুতরাং মিয়ানমার সরকারের কাছে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও এর ইতিবাচক কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। এ সরকার কিছু করবে বলে আমি মনে করি না। এটি আমাদের জন্য দুঃসংবাদই বলা চলে। সেটি হলো, ভারতের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তার পরও ভারতের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে এখন নেই। ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিয়ানমারে ভারত ও চীন উভয় দেশ বড় বিনিয়োগ করে মিয়ানমারকে কাছে টানছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব খর্ব করতে মিয়ানমারে বড় ধরনের বিনিয়োগ করছে ভারত। রাখাইনে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর করছে চীন। যাকে টেক্কা দিতে আগামী বছরই ভারতীয় অর্থায়নে শুরু হচ্ছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাখাইনের সিত্তয়ে বা সাবেক আকিয়াব বন্দর প্রকল্পের কাজ। দিল্লির সহায়তায় চলমান ত্রিপক্ষীয় মহাসড়কসহ বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়েও মিয়ানমার ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। মিয়ানমারে ভারত উন্নয়ন সহযোগিতার পাশাপাশি সামরিক সহযোগিতা করছে সাবমেরিন এবং ট্যাঙ্ক দিয়ে। ভারত নিজের স্বার্থে যেখানে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করছে, সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা কতটা সরব হবে তা বলাই বাহুল্য। ভারত হয়তো সম্পর্কের খাতিরে কূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করতে পারে। তাতে আমাদের কার্যত আশার আলো নেই। তা ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। আমরা জানি, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে রয়েছে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর চুক্তি। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড তথা বিআরআই উদ্যোগের একটি খুঁটি রয়েছে মিয়ানমারে। ফলে এ অঞ্চলে দুই শক্তি চীন ও ভারতের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সুদূরপরাহত। এর সঙ্গে 'ইসলামোফোবিয়া'র বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মিয়ানমারের নির্বাচনের ফল ও রোহিঙ্গা বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রয়োজন 'অ্যাগ্রেসিভ ডিপ্লোম্যাসি' বা আগ্রাসী কূটনীতি। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চলছে বটে; তবে এটি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ বিষয়। তার ওপর সেখানে মিয়ানমার যদি অপরাধী প্রমাণিত হয়ও, তার বিচার হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে। জাতিসংঘে যখন মিয়ানমারের শাস্তির বিষয়টি আসবে, তখন ভেটো ক্ষমতার কোনো রাষ্ট্র ভেটো দিয়ে বসলে শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব হবে না। তবে পশ্চিমা বিশ্ব যদি উদ্যোগ নেয় সেটি সম্ভব হতে পারে। যেমনটা আমরা সুদানে দেখেছি। এ মুহূর্তে তাই কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে নজর রাখতে হবে আমেরিকার দিকে। সেখানে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন সরকারে দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ের দায়িত্বে কে আসছেন, সেটি দেখে কাজ শুরু করতে হবে।
মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ জোন তৈরির জন্য। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে মিয়ানমারের নির্বাচনের ফল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে আমরা আশাবাদী হতে পারছি না। বাংলাদেশের সামনে আসলে 'ফিফথ ডাইমেনশন' বা পঞ্চমাত্রিক ক্ষেত্র ছাড়া উপায় দেখি না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
মন্তব্য করুন