ভূমি বা জমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আজীবনের। পূর্ব ও উত্তর পুরুষের অন্যতম প্রধান বৈষয়িক যোগসূত্রও বটে। কিন্তু এ-সংক্রান্ত যে কোনো সেবা পেতে সেবাপ্রার্থীদের কতটা বিড়ম্বনা কিংবা দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানা। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে যেসব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। এর ফলে সমস্যা কিছুটা নিরসন হয়েছে বটে, কিন্তু এখনও সহজে সেবাপ্রাপ্তির পথ সুগম হয়নি। নিকট অতীতে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনার পথ মসৃণ করতে এ-সংক্রান্ত সবকিছুই ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় জমি নিবন্ধনের আট দিনেই স্বয়ংক্রিয় নামজারির যে সিদ্ধান্ত গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নেওয়া হয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। ফলে ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ অগ্রগতি ঘটল বলে আমরা মনে করি। বর্তমানে এই কার্যক্রম ১৭টি উপজেলায় চলছে; তবে এক বছরের মধ্যে এ প্রক্রিয়া সারাদেশে চালু হবে। আমরা জানি, বর্তমানে ভূমি নিবন্ধনের কাজটি হয় আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের মাধ্যমে। আর নামজারির কাজটি হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এখন থেকে দুই দপ্তরের মধ্যে অভিন্ন 'সফটওয়্যার' থাকবে এবং তা যৌথভাবে পরিচালনা করা হবে। সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে একদিকে যেমন জনভোগান্তি হ্রাস পাবে, অন্যদিকে ভূমি-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও কমে আসবে। আমরা দেখছি, জমি বা ভূমি-সংক্রান্ত মালিকানা বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে প্রতারণাও। দুষ্টচক্র দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা রকম অপকৌশলে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। ভূমি সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোতে খাজনা দেওয়া থেকে শুরু করে নিবন্ধন, নামজারি পর্যন্ত চলে পদে পদে হয়রানি- এও নতুন নয়। নামজারির জন্য জমি বা ভূমির মালিককে যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় তাও সেবাপ্রার্থীদের জন্য বাড়তি বিড়ম্বনা। জায়গা-জমিন এমনিতেই সংবেদনশীল বিষয়। এর সুযোগ নিচ্ছে একশ্রেণির অসাধু। স্বচ্ছতার অভাবেই বাড়ছে দুর্নীতি। সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে শুধু প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনে সুফল মিলবে না। মনে রাখা জরুরি ভূমি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির একটি বড় কারণ সরিষার ভূত। আমাদের মনে আছে, নিকট অতীতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক জরিপে ভূমি খাতকে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করেছিল। এ পরিস্থিতিতে সরকার এ খাতের সেবাপ্রার্থীদের সেবা পাওয়ার পথ কণ্টকমুক্ত করার জন্য পর্যায়ক্রমে যে উদ্যোগ নিচ্ছে তা দুর্নীতি দূরীকরণে তা সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। উল্লেখ্য, ই-নামজারির প্রক্রিয়া চালুর সিদ্ধান্ত এর আগে গৃহীত হলেও কার্যত এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই এখনও কাজ চলছে 'ম্যানুয়ালি'। আলোচ্য ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না আমরা। পাশাপাশি নামজারির ডাটাবেজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়া আরও আধুনিক করলে সেবাপ্রার্থীর ভোগান্তি হ্রাস পাবে। ভূমি খাতের বিদ্যমান সমস্যা ও জনভোগান্তি দূর করার স্বার্থে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনার দাবি আমরাও বিভিন্ন সময়ে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে তুলে ধরেছি। এখন যখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে, তখন আমরা কাজ দেখতে চাই। প্রয়োজন সমন্বয়ও। ভূমির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সরকারের অনেক বিভাগ ও শাখা-প্রশাখা। এ যেন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্বচ্ছতার সঙ্গে জমি রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামজারি ও রেকর্ড সংশোধন প্রক্রিয়া সারাদেশে যত দ্রুত শুরু হবে ততই মঙ্গল। এ ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্ত যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় গণ্ডিবদ্ধ না থাকে এ ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে বিশেষ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। দ্রুত কাজ ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। এক খণ্ড জমি বা ভূমি মানুষের অন্যতম প্রধান সম্বল এবং অবলম্বনও বটে।

বিষয় : স্বয়ংক্রিয় নামজারি

মন্তব্য করুন