আমাদের উপমহাদেশে সব আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রে স্লোগানের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। আন্দোলনকে বেগবান এবং সর্বস্তরে আন্দোলন স্টম্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ার পেছনে স্লোগানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। স্লোগান যে কত দ্রুত ও ব্যাপকভাবে জনমানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করতে সক্ষম তার নজির আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে রয়েছে। স্লোগানকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি স্লোগানও সৃষ্টি হয়েছিল দল ও মতভেদে। পাকিস্তানি আমলে আমাদের রাজনীতি প্রধানত দুই ধারায় বিভক্ত ছিল। একটি জাতীয়তাবাদী, অন্যটি বামপন্থি। দুটি ধারা যেমন ভিন্ন ছিল, তেমনি ছিল স্লোগান মুখরও। জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে বিরোধ না থাকলেও জনগণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বামেরা প্রধান বলেই বিবেচনা করত।
আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ভাষা আন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়ে। ক্রমেই ওই আন্দোলন স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ, মতিউরের আত্মদানে পতন ঘটে আইয়ুব খানের। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে আসাদের আত্মদানের পরক্ষণে 'আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র' স্লোগানটি ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। জাতীয়তাবাদীরা তখন নতুন স্লোগান দেন, 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা'। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসানোর কারণেই মামলাটি গুরুত্ব হারিয়ে রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণের মামলায় পরিণত হয়। ওই মামলার বিরুদ্ধে সমস্বরে মানুষ স্লোগান দেয় 'মিথ্যা মামলা আগরতলা-বাতিল করো, করতে হবে', 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা-মানি না, মানবো না।' শেষ পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম এগোয়নি, গণআন্দোলনে বাধ্য হয়ে সামরিক শাসক গোলটেবিল আহ্বান করে মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তখনই 'জয় বাংলা' স্লোগানটি জনসমক্ষে প্রথম আসে এবং ব্যাপক সাড়া ফেলে। এই স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানে পরিণত হয়। 'জয় বাংলা' স্লোগানের সময়ে বামেরা 'জয় সর্বহারা' স্লোগান নিয়ে হাজির হলেও জাতীয়তাবাদীদের ওপর দেশবাসীর একচেটিয়া আস্থা-সমর্থনের কারণে বামেদের স্লোগানটি সাড়া ফেলতে পারেনি।
'ভোটের আগে ভাত চাই', 'ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো'- এই স্লোগানগুলো ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় উচ্চারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা 'জয় বাংলা' স্লোগানটি সমবেতভাবে দিতেন। তাই 'জয় বাংলা' স্লোগানটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনিতেও পরিণত হয়েছিল। পশ্চিমবাংলায় যাওয়া আমাদের শরণার্থীদের ওই দেশীয়রা 'জয় বাংলার লোক' হিসেবেই সম্বোধন করত। পূর্ববাংলার শরণার্থী মানুষের আত্মপরিচয় হয়ে পড়েছিল 'জয় বাংলার লোক'। স্বাধীন দেশে অনেক রকম স্লোগান দেওয়া হলেও এরশাদের শাসনামলের শেষ দিকে 'স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক' স্লোগানটি আলোড়ন তুলেছিল। নূর হোসেন বুকে-পিঠে ওই স্লোগান লিখে মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হলে দেশব্যাপী এরশাদবিরোধী আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রিকশাযাত্রী বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে গুলি করে হত্যার পর এরশাদের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। তখন স্লোগান ওঠে, 'এক দফা এক দাবি- এরশাদ তুই এখন যাবি।' শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ওইসব স্লোগানে থাকায় মানুষ তা গ্রহণ করে আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। আমাদের ভূখণ্ডের সব আন্দোলন-সংগ্রামে স্লোগান অপরিহার্য উপাদান হিসেবে সব সময়েই কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিতে স্লোগান সব সময়েই নতুন নতুন স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষায় মানুষকে উজ্জীবিত করেছে, আন্দোলনে শামিল করেছে। তবে আমাদের সমষ্টিগত মানুষের দুর্ভাগ্য এ যাবৎকালের আন্দোলন-সংগ্রামের সাফল্যের সুফলভোগী তারা হতে পারেনি।
বহু ত্যাগেও সাধারণ মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার এখনও পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। তাই ব্রিটিশ, পাকিস্তানি শাসনমুক্ত হয়ে স্বজাতির শাসনাধীনে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্যও প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলো না। সেজন্য আরও নতুন স্লোগান আসবে, আন্দোলনের চাকা চলমান থাকবে। স্লোগান কীভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান ও শক্তিশালী করে স্বাধীনতার পূর্বাপর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তা অনেকভাবেই প্রতিভাত হয়েছে। স্লোগান আন্দোলনকারীদের ধমনিতে অন্যরকম শক্তি সঞ্চার করে। স্লোগান কতটা মোক্ষম শক্তি এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে।
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

বিষয় : আন্দোলনে স্লোগানের ভূমিকা

মন্তব্য করুন