- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- মুমিনের পরীক্ষা ও পুরস্কার
মুমিনের পরীক্ষা ও পুরস্কার

মহান আল্লাহ কোরআনুল কারিমের সুরা বাকারার ১৫৫নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন- 'আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। এমন বিপদগ্রস্ত অবস্থায় যারা ধৈর্য ধারণ করবে, তাদের সুসংবাদ দাও।' রাসুল (সা.)-এর বাণী মোতাবেক বলা যায়- 'পৃথিবীটা হচ্ছে পরীক্ষা কেন্দ্র।' মহান আল্লাহ বলেছেন, 'নিঃসন্দেহে তোমাদের সন্তান ও সম্পদ পরীক্ষা স্বরূপ।' মুমিন তথা বিশ্বাসীরাই অধিকতর পরীক্ষার মুখোমুখি হয়, কারণ এতে করে মুমিন বান্দার অপরাধ ও পাপরাশি মার্জনা করা হয় এবং পরকালে শান্তি ও সফলতা প্রাপ্তির জন্য ইহকালে শাস্তি হিসেবেই মূলত তাদের ওপর বিপদ-আপদ নেমে আসে। এসব মানুষের জীবনে নেমে আসা বিপদ, রোগবালাই, মহামারি, সমস্যা- ইত্যাকার নানা বিষয় পরীক্ষা হিসেবেই আসে। হাদিসে এসেছে, 'পরম করুণাময় যখন কাউকে ভালোবাসেন, তখন তাকে নানা বালা-মুসিবত দিয়ে থাকেন।' আর এগুলোর মধ্য দিয়ে তারা মহান স্রষ্টার অজস্র নেয়ামতের প্রকৃত কদর অনুভব করতে পারেন এবং নিজেদের জীবনমানকে প্রতিপালকের প্রত্যাশার আকরে গড়ে তুলতে সক্ষমতা অর্জন করেন। মূলত মুমিন-জীবনের প্রতিটি পর্বে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়; শৈশব, কৈশোর, যৌবন, পৌরুষ এমনকি বার্ধক্যেও সেই পরীক্ষা অব্যাহত থাকতে পারে। আর সেই পরীক্ষা কখনও সুখের, কখনও দুঃখের, কখনও আনন্দ-খুশির আবার কখনওবা বেদনার্ত। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি সেই পরীক্ষা, আয়ুস্কাল সেই পরীক্ষার সময়-পরিধি, পরীক্ষক স্বয়ং আল্লাহ, পরিদর্শক দুই কাঁধে থাকা ফেরেশতাদ্বয় এবং ফলাফল ঘোষণাকারীও মহান পরওয়ারদেগার।
উপরিউক্ত আয়াতে কারিমায় পাঁচটি বিষয়ে মানুষকে পরীক্ষা করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে; যার প্রথমটি হলো ভয়। ভয়ের আরবি শব্দ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে 'খাউফ'। মূলত পবিত্র কোরআনে ভয়ের প্রতিশব্দ হিসেবে নূ্যনপক্ষে ১২টি শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি। কিন্তু আয়াতে উল্লিখিত 'খাউফ' এমন এক বিশেষ ধরনের ভয়, যা আমাদের জীবনে কোনো একটা মুসিবত এসেছে বা আসবে- যা নিয়ে আমরা আতঙ্কে থাকি বা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাই। এ ভয় পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক- যে কোনো ধরনের বিপদ থেকে হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ক্ষুধা বা দারিদ্র্য; এটি মানবজীবনের আরেকটি পরীক্ষার নাম। ইসলামের প্রথম জমানা থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম সমাজে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-কষ্ট যেন নিত্যসঙ্গী। মহানবী (সা.)-এর যুগে ক্ষুধার যন্ত্রণায় অনেকেই পেটে পাথর বাঁধলেও বর্তমানে তা আর সে অবস্থায় নেই। কিন্তু তাই বলে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে আমরা একেবারে মুক্ত নই। অভাব-অনটন, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানুষ তার বিবেক ও চরিত্র বিসর্জন দেয় কিনা, মহান আল্লাহ সেই পরীক্ষায় আদম সন্তানকে ফেলে দেন। অভাব যাদের নিত্যসঙ্গী, ক্ষুধা যাদের জীবনে লেগেই থাকে, তারা পুরোপুরি কৃতজ্ঞশীল হয়ে শান্তি নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে সমর্থ হয় না। তৃতীয়ত, সহায়-সম্পদের ক্ষতি; যার মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষের পরীক্ষা নেবেন। হয়তো অঢেল সম্পদের মালিক কখনও রাস্তার ভিখারি হয়ে যাবেন, সম্পদশালী ব্যক্তি কোনো কারণে নিঃস্ব হয়ে যাবেন; এটিকে স্রষ্টার এক নির্ধারিত পরীক্ষা হিসেবে আমলে নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। সম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা মহান আল্লাহর, এটি কারও কাছেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়- এ অমোঘ সত্যকে মেনে নিতে হবে। সম্পদ হাতছাড়া হলেই মাতম শুরু করা চলবে না, বরং পরম আরাধ্যে তা অতিক্রম করতে হবে এবং নিজেকে বুঝাতে হবে যে, আল্লাহর পরীক্ষা চলছে; আর এ থেকে আমার উত্তরণও ঘটবে। চতুর্থত, জীবনের ক্ষয়ক্ষতি; অর্থাৎ প্রিয়জন, আপনজন হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে যে কঠিন পরীক্ষা, তাও কাটিয়ে উঠতে হবে। সর্বদাই অন্তঃকরণে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল রাখতে হবে, জীবন-মৃত্যু একমাত্র মহান আল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনিই জন্ম দেন, তিনিই মৃত্যু ঘটান। একমাত্র অবলম্বন অনেক সময় ইহধাম ত্যাগ করতে পারে, জীবনটাকে তখন অর্থহীন মনে হতে পারে। চরম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তখন ধৈর্যের পরাকাষ্টা বহন করতে হবে। প্রিয়জনের অকাল মৃত্যু, অপমৃত্যু- কত কিছুই না মানবজীবনে ঘটতে পারে, বর্তমান মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে নিত্যদিন কত প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ মানুষ চলে যাচ্ছে- এসবই মহান রবের পরীক্ষা হিসেবে নিতে হবে। পঞ্চমত, ফল-ফসলাদির ক্ষতি; অর্থাৎ জমিনে উৎপাদিত পণ্য, ফল বা ফসলাদির নানা কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির মাধ্যমে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। খাদ্যের স্টক শেষ হয়ে যাওয়া, লোনে জর্জরিত হওয়া, খরা বা বন্যায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়া, নদীভাঙনের কবলে পড়া, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হওয়া- এসবই সেই প্রতিশ্রুত পরীক্ষারই অংশ।
উপরোল্লিখিত পরীক্ষাগুলোতে অবতীর্ণ হয়ে যারা সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হবে, তাদের জন্যই রয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার। মহাসত্যে বিশ্বাস স্থাপনকারী বান্দাদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরস্কার হিসেবে অসংখ্য নাজ-নেয়ামতে ভরপুর পরম স্বর্গোদ্যান তথা জান্নাতুল ফেরদাউসের নিশ্চয়তা ছাড়া আর কী হতে পারে! মহান আল্লাহ বলেন, 'যারা বিপদ-মুসিবতে নিপতিত হয়েও বলে আমরা তো পরম রবের জন্যই এবং তাঁর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন। আর এরাই হচ্ছে সেই সব বান্দা, যাদের ওপর মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও করুণা বর্ষিত হয় এবং এরাই প্রকৃত অর্থে সৎপথে পরিচালিত।' রাসুলের (সা.) বাণী- 'কোনো বান্দাকে ধৈর্যের মতো উত্তম সম্পদ আর কিছুই দেওয়া হয়নি।' আল্লাহপাক এমন মানুষের জন্যই সুনির্দিষ্ট করে রাখবেন জান্নাত ও তার সব নেয়ামত; যার তলদেশ দিয়ে নহরগুলো প্রবাহিত রয়েছে। সেখানে তারা মহান রবের অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করবে, যা আর কখনোই নিঃশেষ হবে না এবং কস্মিনকালেও আর মৃত্যু তাদের পাকড়াও করতে পারবে না বরং একই অবস্থায় তারা থাকবে অনন্তকাল। করোনা মহামারির এই ভয়াবহ দুঃসময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমরা যেন পরম রবের প্রতিশ্রুত পুরস্কার লাভে ধন্য হতে পারি, সেই প্রার্থনা করি।
চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উপরিউক্ত আয়াতে কারিমায় পাঁচটি বিষয়ে মানুষকে পরীক্ষা করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে; যার প্রথমটি হলো ভয়। ভয়ের আরবি শব্দ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে 'খাউফ'। মূলত পবিত্র কোরআনে ভয়ের প্রতিশব্দ হিসেবে নূ্যনপক্ষে ১২টি শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি। কিন্তু আয়াতে উল্লিখিত 'খাউফ' এমন এক বিশেষ ধরনের ভয়, যা আমাদের জীবনে কোনো একটা মুসিবত এসেছে বা আসবে- যা নিয়ে আমরা আতঙ্কে থাকি বা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাই। এ ভয় পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক- যে কোনো ধরনের বিপদ থেকে হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ক্ষুধা বা দারিদ্র্য; এটি মানবজীবনের আরেকটি পরীক্ষার নাম। ইসলামের প্রথম জমানা থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম সমাজে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-কষ্ট যেন নিত্যসঙ্গী। মহানবী (সা.)-এর যুগে ক্ষুধার যন্ত্রণায় অনেকেই পেটে পাথর বাঁধলেও বর্তমানে তা আর সে অবস্থায় নেই। কিন্তু তাই বলে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে আমরা একেবারে মুক্ত নই। অভাব-অনটন, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানুষ তার বিবেক ও চরিত্র বিসর্জন দেয় কিনা, মহান আল্লাহ সেই পরীক্ষায় আদম সন্তানকে ফেলে দেন। অভাব যাদের নিত্যসঙ্গী, ক্ষুধা যাদের জীবনে লেগেই থাকে, তারা পুরোপুরি কৃতজ্ঞশীল হয়ে শান্তি নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে সমর্থ হয় না। তৃতীয়ত, সহায়-সম্পদের ক্ষতি; যার মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষের পরীক্ষা নেবেন। হয়তো অঢেল সম্পদের মালিক কখনও রাস্তার ভিখারি হয়ে যাবেন, সম্পদশালী ব্যক্তি কোনো কারণে নিঃস্ব হয়ে যাবেন; এটিকে স্রষ্টার এক নির্ধারিত পরীক্ষা হিসেবে আমলে নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। সম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা মহান আল্লাহর, এটি কারও কাছেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়- এ অমোঘ সত্যকে মেনে নিতে হবে। সম্পদ হাতছাড়া হলেই মাতম শুরু করা চলবে না, বরং পরম আরাধ্যে তা অতিক্রম করতে হবে এবং নিজেকে বুঝাতে হবে যে, আল্লাহর পরীক্ষা চলছে; আর এ থেকে আমার উত্তরণও ঘটবে। চতুর্থত, জীবনের ক্ষয়ক্ষতি; অর্থাৎ প্রিয়জন, আপনজন হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে যে কঠিন পরীক্ষা, তাও কাটিয়ে উঠতে হবে। সর্বদাই অন্তঃকরণে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল রাখতে হবে, জীবন-মৃত্যু একমাত্র মহান আল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনিই জন্ম দেন, তিনিই মৃত্যু ঘটান। একমাত্র অবলম্বন অনেক সময় ইহধাম ত্যাগ করতে পারে, জীবনটাকে তখন অর্থহীন মনে হতে পারে। চরম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তখন ধৈর্যের পরাকাষ্টা বহন করতে হবে। প্রিয়জনের অকাল মৃত্যু, অপমৃত্যু- কত কিছুই না মানবজীবনে ঘটতে পারে, বর্তমান মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে নিত্যদিন কত প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ মানুষ চলে যাচ্ছে- এসবই মহান রবের পরীক্ষা হিসেবে নিতে হবে। পঞ্চমত, ফল-ফসলাদির ক্ষতি; অর্থাৎ জমিনে উৎপাদিত পণ্য, ফল বা ফসলাদির নানা কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির মাধ্যমে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। খাদ্যের স্টক শেষ হয়ে যাওয়া, লোনে জর্জরিত হওয়া, খরা বা বন্যায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়া, নদীভাঙনের কবলে পড়া, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হওয়া- এসবই সেই প্রতিশ্রুত পরীক্ষারই অংশ।
উপরোল্লিখিত পরীক্ষাগুলোতে অবতীর্ণ হয়ে যারা সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হবে, তাদের জন্যই রয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার। মহাসত্যে বিশ্বাস স্থাপনকারী বান্দাদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরস্কার হিসেবে অসংখ্য নাজ-নেয়ামতে ভরপুর পরম স্বর্গোদ্যান তথা জান্নাতুল ফেরদাউসের নিশ্চয়তা ছাড়া আর কী হতে পারে! মহান আল্লাহ বলেন, 'যারা বিপদ-মুসিবতে নিপতিত হয়েও বলে আমরা তো পরম রবের জন্যই এবং তাঁর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন। আর এরাই হচ্ছে সেই সব বান্দা, যাদের ওপর মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও করুণা বর্ষিত হয় এবং এরাই প্রকৃত অর্থে সৎপথে পরিচালিত।' রাসুলের (সা.) বাণী- 'কোনো বান্দাকে ধৈর্যের মতো উত্তম সম্পদ আর কিছুই দেওয়া হয়নি।' আল্লাহপাক এমন মানুষের জন্যই সুনির্দিষ্ট করে রাখবেন জান্নাত ও তার সব নেয়ামত; যার তলদেশ দিয়ে নহরগুলো প্রবাহিত রয়েছে। সেখানে তারা মহান রবের অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করবে, যা আর কখনোই নিঃশেষ হবে না এবং কস্মিনকালেও আর মৃত্যু তাদের পাকড়াও করতে পারবে না বরং একই অবস্থায় তারা থাকবে অনন্তকাল। করোনা মহামারির এই ভয়াবহ দুঃসময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমরা যেন পরম রবের প্রতিশ্রুত পুরস্কার লাভে ধন্য হতে পারি, সেই প্রার্থনা করি।
চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন