আজ যে সময়ে আমরা শহীদ ডা. মিলনকে স্মরণ করছি তখন গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় অনেকটা পর্যুদস্ত। বিশ্ববাসী অপেক্ষায় কার্যকর নিরাপদ ভ্যাকসিনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি অনেকটা সামলানো গিয়েছিল। কিন্তু এখন দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় চিন্তা করতে হচ্ছে। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও ২৩ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনের এক পর্যায়ের কর্মসূচি ছিল- সারাদেশের চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে জরুরি চিকিৎসা বহাল রেখে ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং পিজি হাসপাতালের বটতলায় সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় চিকিৎসক সমাবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশপাশে চলছিল উত্তপ্ত মিছিল-সমাবেশ। এর মধ্যে ২৭ নভেম্বর ডা. জালালের সঙ্গে পিজি হাসপাতালের সভায় যোগদানের জন্য একই রিকশায় যাচ্ছিল ডা. মিলন। রিকশাটি টিএসসি চত্বরে যেতেই বুলেট কেড়ে নিল ডা. মিলনের প্রাণ। সঙ্গে সঙ্গে মিলনকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো। সেখানে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মিলন চলে গেল ওপারে। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক-ছাত্র-সর্বস্তরের মানুষ নেমে এলো রাজপথে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের দাবিতে। ৪ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর তারা ঘরে ফেরে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশ গড়ার পাশাপাশি দেশের মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন, একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে চাই একটি স্বাস্থ্যবান জাতি। এ জন্য তিনি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি গ্রহণ করেছিলেন সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের আমলে 'জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি' বিষয়টি সামনে চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এ দেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) শুরু থেকেই দেশে একটি গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য দাবি উত্থাপন করে আন্দোলন করছিল। এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও মেডিকেল শিক্ষার উন্নয়নে বিএমএর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ১৯৯০-তে চিকিৎসকদের প্রাণের দাবি ২৩ দফা বাস্তবায়নের আন্দোলন চলছিল। এ দাবিতে চিকিৎসকদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না; ছিল গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাস্তবায়নে নীতিমালা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, অবকাঠামো সংস্কার, বাজেট, মেডিকেল শিক্ষা সংস্কারসহ নানা অতীব জরুরি বিষয়। '৯০-এর জানুয়ারি থেকেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, এরশাদ সরকার একটা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে। ৪ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণে জেনারেল এরশাদ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে জাতির সামনে তাদের হেয় করে বক্তৃতা দিলেন। এতে চিকিৎসক সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হলো। ডা. এমএ মাজেদ-ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বিএমএ তখন একদিকে কর্মসূচি দিল এবং অন্যদিকে দেশব্যাপী চিকিৎসকদের সংগঠিত করার জন্য সাংগঠনিক সফরে বের হলো।
১৬ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতি কলেজের ১নং গ্যালারিতে আয়োজন করে চিকিৎসক সমাবেশ, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএমএ নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা শহরের সিনিয়র-জুনিয়র চিকিৎসকরা। সেদিন স্বৈরাচার সরকারের গণবিরোধী স্বাস্থ্যব্যবস্থা স্থাপনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েন চিকিৎসকরা। সভা শেষে বিরাট মিছিল নিয়ে প্রথমবারের মতো রাজপথে নেমে আসে দেশের চিকিৎসক সমাজ। ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি এরশাদ বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে এ দেশের চিকিৎসকদের নগ্ন সমালোচনা করে জাতির সামনে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণা করলেন। এ নীতিতে বিএমএ বা চিকিৎসকসহ কোনো মহলেরই কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওই স্বাস্থ্যনীতি ছিল একেবারে অবাস্তব। জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার খর্ব করে মহল বিশেষের স্বার্থনির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থার পাঁয়তারা। বিএমএ, সব রাজনৈতিক দল তা প্রত্যাখ্যান করে। ২৭ জুলাই ছিল বিএমএর পূর্ব ঘোষিত শহীদ মিনারে জাতীয় চিকিৎসক মহাসমাবেশ এবং বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিশেষ সাধারণ সভা। সেখান থেকে 'গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ও ২৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন'-এর জন্য চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। চিকিৎসকদের গণপদত্যাগ, কর্মবিরতি, গণসংযোগ, সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসক সমাজ বিএমএর নেতৃত্বে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলে। অবশেষে ১৪ আগস্ট চিকিৎসকদের তুমুল আন্দোলনের মুখে সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি প্রেসনোট বিএমএর কাছে পাঠানো হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

ডা. শামসুল আলম খান মিলন, ১৯৫৭-১৯৯০

চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন না, বিএমএ চেয়েছিল সবার গ্রহণযোগ্য, সংশ্নিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী একটি স্বাস্থ্যনীতি। বিএমএকে সরকারের চুক্তি ভঙ্গ করার কারণে আবার আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা হলো। চিকিৎসকদের এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল এবং বাম জোটের ৫ দল। দেশে তখন চলছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আর অন্যদিকে বিএমএর নেতৃত্বে চিকিৎসকদের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল এবং ২৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন। ২৭ নভেম্বর ছিল বিএমএর দেশব্যাপী কর্মসূচি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজিত সভায় যাওয়ার পথে ডা. মিলন টিএসসি চত্বরে শহীদ হন। শহীদ ডা. মিলন, নূর হোসেন, জিহাদের মৃত্যু এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করে এবং ৬ ডিসেম্বর ৯ বছরের স্বৈরশাসনের পতন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পরই ৮ ডিসেম্বর গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন; কিন্তু স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেই জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং হাস-১/স্বানী-২/৯৫/১১৭ সূত্র মোতাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সভাপতি করে ২৬ সদস্যের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ২০০০ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি সর্বস্তরের জনগণের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০১১ সালে এ স্বাস্থ্যনীতি হালনাগাদ করা হয়।
উন্নত বিশ্বে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নীতিনির্ধারণে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা অপরিসীম, কখনও কখনও প্রধান। করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে দুর্বলতা উন্মোচন করেছে, করোনা প্রতিরোধের মাধ্যমেই তার জরুরি সামগ্রিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এজন্য কিছু প্রস্তাব রাখছি- ১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ : একটি স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে অবকাঠামো এবং কর্মচারীদের দায়িত্ব পুনর্গঠন করতে হবে। যেখানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি কাজের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং এবং ফলোআপ থাকতে হবে। ২. স্বাস্থ্য জনশক্তি পরিকল্পনা : জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট-কর্মচারীদের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ৩. বাজেট :প্রয়োজনীয় বাজেট (জাতীয় বাজেটের নূ্যনতম ১০%) বরাদ্দ এবং এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ৪. নিয়োগ ও বদলি নীতিমালা : চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিংসহ একটি গ্রহণযোগ্য বদলি-পদোন্নতি কার্যকর নীতিমালা, ৫. মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন : স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করেছে শিক্ষা ও সেবার মান কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, ৬. বিএমডিসিকে কার্যকর ও শক্তিশালী করা, ৭. বেসরকারি কলেজ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনা : বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব ও সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে সরকারের নীতিমালা হালনাগাদ করে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা, ৮. চিকিৎসা ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ৯. স্বাস্থ্য প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ১০. রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, ১১. মেডিকেল ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শক্তিশালী করা এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের পথ সুগম করা, ১২। প্রতিটি হাসপাতালে অভ্যর্থনা ও তথ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা।
শহীদ ডা. মিলনের ৩০তম শাহাদাতবার্ষিকীতে আমরা এ দেশের চিকিৎসক সমাজ ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ মেধা, শক্তি, সুযোগ কাজে লাগাব- এটিই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।

 অধ্যাপক; সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়