ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি মূলত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়ে পাঠদান করেন। ট্রানজেকশনাল অ্যানালিসিস এবং নিউরো-লিঙ্গুস্টিক প্রোগ্রামিং-এ প্রশিক্ষণ ও সনদপ্রাপ্ত মেহতাব খানম কাউন্সেলিং সাইকোলজি বা সাইকোথেরাপি বিষয়ে দেশে ও দেশের বাইরে নানাবিধ কোর্স এবং কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একজন কনসালট্যান্ট কাউন্সেলর ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট কাউন্সেলর হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে
সমকাল: কিছুদিন আগে মানসিকভাবে অসুস্থ বরিশালের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমকে ঢাকার আদাবরের 'মাইন্ড এইড' নামের কথিত এক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে সেখানকার কর্মীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
মেহতাব খানম: করোনা সংক্রমণের পর দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার বেহাল অবস্থা যেভাবে ফুটে উঠেছে ঠিক তেমনি এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে মানসিক চিকিৎসার দুরবস্থাও প্রতিফলিত হয়েছে। দেশে অনেক দিক দিয়েই স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনও পিছিয়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার।
সমকাল: ওই ঘটনার পর এটা জানা গেছে, হাসপাতালটিতে টর্চার সেল বলে পরিচিত রুমে প্রায়ই মানসিক রোগীদের এভাবে পেটানো হতো। হাসপাতালটির যে অনুমোদন নেই সেটাও জানা গেছে ওই হত্যাকাণ্ডের পর। এ ধরনের অননুমোদিত চিকিৎসাকেন্দ্র কীভাবে চলছে?
মেহতাব খানম: রোগীকে এভাবে জেলখানার মতো বদ্ধঘরে আটকে রেখে চিকিৎসা করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাইরের দেশে মানসিক অসুস্থদের কমিউনিটির মধ্যে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। একটা সম্পূর্ণ কমিউনিটিতে চিকিৎসক থাকবেন, শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকবে, খোলা জায়গা থাকবে, সংস্কৃতি চর্চা থাকবে, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ থাকবে, অর্থাৎ একটা কমিউনিটি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে। কিন্তু আমাদের এখানে সেরকম কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এছাড়া দেশে মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকাতে এ ধরনের অননুমোদিত কেন্দ্র গড়ে উঠছে। এটা চিকিৎসার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। এজন্য হাসপাতালের ঝাড়ুদার হয়েও রোগীর সেবা দিচ্ছে এমন ঘটনাও ঘটছে।
সমকাল: মানসিক চিকিৎসা নিয়ে এত অবহেলার কারণ কী?
মেহতাব খানম: অনেকে মানসিক অসুস্থতা কী সেটাই জানেন না। আবার কারও পরিবারে কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলে সেটা লুকানোর একটা প্রবণতা থাকে। কখনও কখনও অভিভাবক চাইলেও রোগী চিকিৎসা করাতে রাজি হন না। অনেক রোগী আবার তাকে মেরে ফেলবে এমন সন্দেহপ্রবণ থেকে চিকিৎসা করাতে চান না। অথচ মানসিক অসুস্থতা যে বড় ধরনের সমস্যা এটা অনেকে বুঝতে চান না। কিংবা বুঝলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ প্রশিক্ষিত লোক দরকার সেই সংখ্যক লোক আমাদের দেশে নেই। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে পেশাগত জায়গা, সব জায়গাতেই সাইকোথেরাপিস্ট দরকার- এটা শুধু মুখেই বলা হয়। এর জন্য যে পরিকল্পনা বা উদ্যোগের দরকার তা নেওয়া হচ্ছে না। অথচ গবেষণা বলছে, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিষণ্ণতা হয়ে উঠবে বিশ্বের প্রধান রোগ।
সমকাল: সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের মধ্যে নৃশংসতা, হিংস্রতা ক্রমেই বাড়ছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
মেহতাব খানম: ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় থাকায় এখনকার শিশুরা অনেক বেশি নৃশংস ভিডিওগেম দেখে। তাদের মস্তিস্ক স্থির থাকছে না। মানুষ সারাক্ষণ ছুটছে। মস্তিস্ক বিশ্রাম পাচ্ছে না। অন্যান্য দেশে মস্তিস্ক স্থির রাখার জন্য মেডিটেশন, ব্যায়াম, ইয়োগার মতো বিষয় উৎসাহিত করা হয়। আমাদের এখানে এসবের চর্চা নেই। শিশুরা বিচ্ছিন্নভাবে বেড়ে উঠছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকছে না। অস্থিরতার কারণে মানুষ একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। আশপাশের মানুষের সঙ্গেও সম্পর্ক থাকছে না। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যত বেশি যোগাযোগ থাকবে, একজন আরেকজনের সঙ্গে সময় কাটাবে, ততই মানুষ উন্নত হবে। সে জায়গা থেকে প্রায় সবাই সরে যাচ্ছে।
সমকাল: অনেক মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মানসিক রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। এ ধরনের মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা কতটা সমুচিত?
মেহতাব খানম: মাদকাসক্ত হলে অনেকের মানসিক রোগ হয়। সেক্ষেত্রে তার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয় এটা ঠিক। মানসিক রোগ কিংবা মাসকাসক্তের লক্ষণ কাছাকাছি হওয়ায় দুটিকে অনেকে আলাদা করতে পারছেন না। তবে দুটি ব্যাপার আলাদা। এই দুই চিকিৎসা একসঙ্গে হওয়া ঠিক নয়। এতে আরেক পক্ষের সমস্যা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ মাদক নিরাময় কেন্দ্র মাদকাসক্ত আর মানসিক রোগীকে একত্রে রাখছে। অথচ মানসিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যেরকম পরিবেশ, সাইকোথেরাপিস্ট দরকার সেটা বেশিরভাগ মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নেই।
সমকাল: একটি চিকিৎসাকেন্দ্র কিংবা মানসিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করছেন বা করবেন তাদের আচরণগত ব্যাপারে প্রশিক্ষণের বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মেহতাব খানম: যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের অবশ্যই মানসিক রোগী ও তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হতে হবে। যেহেতু এ ধরনের রোগীরা অনেক বেশি সংবেদনশীল এজন্য তাদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল হতে হবে। এ ধরনের রোগীকে যারা সেবা দেবেন তাদের অবশ্যই প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
সমকাল: মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে কোন বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়া দরকার?
মেহতাব খানম: করোনা মোকাবিলায় যেমন শুধু আইসিউ বেড বা ভেন্টিলেশন বাড়ালে চলবে না, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করতে শুধু হাসপাতাল বাড়ালেই হবে না। এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শহরে শুধু বড় বড় ভবন তৈরি করা হচ্ছে, কিন্তু হাঁটার জন্য, নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য, শিশুদের খেলার জন্য যে মাঠ দরকার বা খোলা জায়গা দরকার তার কোনো পরিকল্পনা নেই। শিশুরা প্রকৃতির কাছে যেতে পারছে না। মানুষের বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগাযোগ নেই, সংস্কৃতির চর্চা নেই। তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে কী করে? মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এই বিষয়গুলো পরিকল্পনায় থাকা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ এ অংশটি খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এ নিয়ে বেশি বেশি কথা বলতে হবে। শিশু মানসিকভাবে অসুস্থ হলে পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পারছেন না। তাকে যে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া প্রয়োজন এটিও তারা ভাবছেন না। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি স্কুলগুলোতেও এ ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজন। আমেরিকায় অনেক স্কুলে শিক্ষকদের আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বোঝার জন্য। শিশুদের ভালোবাসেন এমন দু'জন শিক্ষককে সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। অনেক শিশুই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আবার পারিবারিক অনেক সমস্যার কারণে তার পড়াশোনায় মনোযোগ থাকছে না, আচরণগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ধরনের শিশুর অনেক সময় কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া পেশাক্ষেত্রেও সাইকোথেরাপিস্টের প্রয়োজন। অনেকেই পেশাগত কারণে রাগ, হতাশায় ভোগেন। তখন তার কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা দরকার।
সমকাল: দেশে মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করতে কী করা প্রয়োজন?
মেহতাব খানম: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গৎবাঁধা অনেক প্রশিক্ষণ হচ্ছে, যেগুলো কোনো কাজের নয়। এসব প্রশিক্ষণের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেড় বছরের ইন্টার্নশিপ করার পর অনেককে ক্লিনিক্যাল থেরাপিস্টের সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের পড়াশোনা বাস্তবসম্মত নয়। যদি কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ঠিক করার মতো রোগ হয় তবে তাকে যেতে হবে মনোবিদ বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে, সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নয়। এটা অনেকে বুঝতে পারেন না। মানসিক চিকিৎসায় যে ফ্যামিলি থেরাপির দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার এটাও অনেকে জানেন না। সমস্যা হলেই মানুষ সাইকিয়াটিস্টের কাছে ছুটছেন। তিনি ওষুধ দিচ্ছেন, অথচ তার দরকার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া। এছাড়া মানসিক রোগীদের পরিচর্যার জন্য প্রশিক্ষিত নার্সও দরকার, যেটা আমাদের এখানে নেই। সর্বোপরি সোশ্যাল ওয়ার্কার, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট ও প্রশিক্ষিত নার্স- এই চারের সমন্বয়ে গঠিত টিম প্রয়োজন মানসিক চিকিৎসার জন্য।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহতাব খানম: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভ কামনা।

বিষয় : সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক মেহতাব খানম

মন্তব্য করুন