- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- নারীর অধিকার নিশ্চিত হোক
নারীর অধিকার নিশ্চিত হোক
আমাদের সমাজে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার যে হার দেখা যাচ্ছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। বিশেষত, চলমান করোনা-দুর্যোগের মধ্যে যেভাবে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন বেড়েছে, তা রোধে বুধবার মানবাধিকার কমিশন ও সমকালের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। আলোচনা সভায় বক্তারা যথার্থই বলেছেন, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সমকাল তার সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস সামনে রেখে ১৬ দিনব্যাপী লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এই প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়েছে। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে এক ধরনের জাগরণ আমরা দেখেছি। এমনকি কয়েকটি মামলায় দ্রুত বিচারের দৃষ্টান্তও আদালত সৃষ্টি করেছেন।
মতবিনিময় সভায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যথার্থই বলেছেন, 'ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন করার পর মনে করেছিলাম, সহিংসতার ঘটনা কমবে। কিন্তু যে তথ্য-উপাত্ত মিলছে, তাতে এসব কমার কোনো লক্ষণই নেই।' তবে এটা সত্য যে, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতায় সাম্প্রতিক অঘটনগুলোতে পুলিশ ও প্রশাসন তৎপর হয়েছে; প্রধানমন্ত্রী নিজেও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিচারে কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। এমনকি শারীরিক পরীক্ষার জটিলতা নিরসনে সম্প্রতি আদালত বলেছেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সাক্ষ্য বিবেচনায় ধর্ষণ মামলায় আসামিকে সাজা দেওয়া যাবে। এখানে ধর্ষণ প্রমাণে মেডিকেল রিপোর্ট মুখ্য নয়, পাশাপাশি কোনো ভুক্তভোগী দেরিতে মামলা করলে তাকেও মিথ্যা বলা যাবে না। তারপরও ভার্চুয়াল আলোচনায় মানবাধিকারকর্মী আরোমা দত্তের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা বহুলাংশে একমত, 'সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যমসহ আমরা সবাই চেষ্টা করছি- তার পরও কোথাও একটি সমন্বয়ের অভাব থেকে যাচ্ছে।' আমরা মনে করি, সমন্বিত উদ্যোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই জনসচেতনতার বিষয়টি যেমন অগ্রাধিকার দিতে হবে, তেমনি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তনের ওপরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। আমরা দেখছি, সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ ও নারীর ক্ষমতায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন খাতে নারী নেতৃত্ব দিচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী গত মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের ভার্চুয়াল বৈঠকে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকারও করেছেন। বস্তুত কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কেবল আশানুরূপভাবে বাড়ছেই না, বরং ভালোও করছে। গত দুই দশকে জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৫ অনুযায়ী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী-পুরুষের বৈষম্য হ্রাস এবং নারী শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশের ইতিবাচক অগ্রগতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে সহিংসতা বৃদ্ধির চিত্র কেবল বাংলাদেশেই নয়। উন্নত দেশগুলোতেও করোনা মহামারির এ সময়ে নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে এটি যেহেতু আমাদের আবহমান সমস্যা, সেহেতু নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আরও গভীরভাবে কাজ করতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা কমাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখা দরকার, আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেকই যেখানে নারী, সেখানে দেশের উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার, সমাজ, কর্মস্থল, যানবাহন কোথাও যখন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না; কোথাও যখন নারীর প্রতি নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না; এভাবে তাদের দমিয়ে রাখার অর্থ হলো, আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করা।
মন্তব্য করুন