এবার বিজয় দিবস জাতি যখন পালন করছে, তখন ড. আনিসুজ্জামান নেই, কামাল লোহানী নেই, রশিদ হায়দার নেই। আলী যাকের চলে গেলেন, আরও অনেকে বিদায় নিয়েছেন করোনায় বা অন্য কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে। প্রতিদিন কেউ না কেউ চিরতরে চলে যাচ্ছেন জাতিকে অসহায়ত্বের মধ্যে নিক্ষেপ করে। করোনাদুর্যোগ আমাদের গণ্ডিবদ্ধ করে দিয়েছে।
এমন দুর্যোগ একাত্তরের আগে বা পরে কোনোদিনই প্রত্যক্ষ করতে হয়নি বাঙালি জাতিকে। জীবন অনিশ্চিত করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় উত্তাল তরঙ্গের আশঙ্কায়। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার বহু দেশ করোনার দ্বিতীয় আঘাতে আতঙ্কিত। একাত্তর ছিল বাঙালি জাতির বাঁচার সংগ্রাম। পেছনে ফেলে আসা জাতীয় অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সমগ্র জাতির সম্মিলিত প্রয়াসে মরণপণ সংগ্রাম। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় আমাদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি সব প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই মাস্ক পরিধান, বারবার সাবানজলে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা- এই বিষয়গুলো সামনে রেখে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী নতুনভাবে পালনের সুযোগ করে দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হোক। শহর, নগর, বন্দর, ইউনিয়ন, গ্রাম, উপজেলা, জেলা- সব পর্যায়ে। 
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীও চলছে। তাই আজীবনের লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন, ভাষাশহীদ, ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনারা যে মহান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রত্যয়ী হয়েছিলেন- স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আগে এসবের বাস্তবায়নে চাই দৃঢ় অঙ্গীকার। পথকে কণ্ঠকাকীর্ণ রেখে, বিপদাশঙ্কা সর্বদা মাথায় নিয়ে ওই মহান প্রতিশ্রুতি ও স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব। বিগত প্রায় পাঁচ দশকের ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। সেই শিক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়েই এগোতে হবে। আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের বক্তৃতা-ভাষণ-প্রতিশ্রুতিগুলো জাতির জীবনে বাস্তবিকভাবে প্রতিফলিত করতে চাই তবে বৈষম্য দূর করতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম চেতনা সাম্প্রদায়িকতার মূলোচ্ছেদ ও ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ, যেখানে মানুষে মানুষে সমমর্যাদা, সমঅধিকার ভোগের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে সব সাম্প্রদায়িক শক্তি নির্মূল করা, বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়া এবং সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ। জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ সব ধর্মাশ্রয়ী দল ও সংগঠনকে বেআইনি ঘোষণা করে সংবিধান সংশোধনই হবে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নীতিনিষ্ঠ পদক্ষেপ। বাঙালি বিজয়ী জাতি। ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী ২৩ বছরের নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে যে গৌরবজনক অর্জনগুলো জাতির জন্য দুর্লভ সম্মান এনে দিয়েছিল- আজ ধর্মান্ধ, উগ্রবাদীরা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরি করলে তা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপের প্রকাশ্য হুমকি দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখায়। যাদের পরাজিত করে এই বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাদের ইন্ধনে আবার অপতৎপরতা?
এসবই কি বেদনার? না, নিশ্চয়ই ইতিহাস তা বলে না। বাঙালি সব সংগ্রামেই সুদীর্ঘ অতীত থেকে একের পর এক বিজয় অর্জন করে এসেছে ১৯৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত। তার পরেও বাঙালি ক্ষান্ত হয়নি। আশির দশকব্যাপী যে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে অগণতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধে জাতি বিজয় অর্জন করেছিল- তাও সারা পৃথিবীতে নজিরবিহীন। সামরিক শাসন বহু দেশেই জারি হয়েছে অতীতে কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তার অবসান ঘটানোর নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার শত্রুরা নানা দুর্বলতার কারণে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অর্জন করেছে। সতর্ক করে বলতে চাই, স্বাধীনতার ওই চিহ্নিত শত্রুরা যদি অনেক বেশি শক্তি অর্জন করে থাকে তবে নিশ্চয়ই তারা দেশের অনেক বেশি ক্ষতি সাধন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। সরকারসহ দেশপ্রেমিক সব মানুষ ও সংগঠনের সতর্কতা গভীরভাবে আজ প্রয়োজন। আজ আবার যূথবদ্ধ হয়ে অপশক্তিকে হটিয়ে দিতে হবে। তাদের রুখে দেওয়ার প্রত্যয় চাই।


  সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
raneshmaitra@gmail.com

বিষয় : অপশক্তিকে রোখার প্রত্যয় চাই

মন্তব্য করুন