দুপুর পেরিয়ে বিকেল। রোদরোদ্দুররৌদ্রে মাখা ঝলমলে, ঝকঝকে আকাশ। অথচ, না ভারতের, না পাকিস্তানের কোনো বোমারু বিমান নেই। হতে পারে কি? কোনো ভোঁ ভোঁ আওয়াজ, গগনবিদারী সাইরেন বাজছে না। ঘটনা কী তবে? গত কয়েকদিন রাতের ঘুম, দিনের খাওয়া গোল্লায় গেছে। ভারতের না পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান আকাশে, মাটি থেকে ঠাওর করা দুস্কর, কিন্তু কোনো যুদ্ধবিমান নেই, মহড়াও দিচ্ছে না, আরও কিছু ভয়ংকর? প্রত্যেকেই উৎকণ্ঠা, উত্তেজনায় প্রায় দিশেহারা। বাঁচা না বাঁচার সময়কালের প্রতীক্ষায়।
বিকেলের পরে, সূর্যালো তখনও পরিস্কার, এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি বিমান ফুড়ূৎ করে উড়ে গেল বেশ নিচু, লিফলেট ছড়াল, ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা : 'নিরাপদে আশ্রয় নিন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।' নিশ্চয় ভারতীয় যুদ্ধবিমান থেকেই এই লিফলেট, হাজার হাজার লিফলেট। ভয়ে যারা ঘরবন্দি,
এক লহমায় রাস্তায়, মাঠে। কাড়াকাড়ি শুরু হলো, কে কত লিফলেট হাতিয়েছে। আমরাও পেলাম- ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের কথা বলছি।
গোটা রাত সজাগ, সকালের নাশতাও বাসি। কী হলো? দিনমান সাড়াশব্দ নেই, বোমারু বিমানও নেই। রাস্তায় পাকিস্তানি মিলিটারির টহলও নেই। নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। 'আমাদের কিচ্ছু হবে না'- বললেন বারি ভাই। বলার হেতু, আমরা আছি বেগমবুর বাড়িতে। বাড়িটি ৩২ নম্বর ধানমন্ডির প্রথম বাড়ি। কয়েক বাড়ি পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। তার বাড়ি পাকিস্তানি সৈন্য, ভারতীয় সৈন্য, হোক তা পদাতিক বিমানের কেউ আক্রমণ করবে না, কৌশলগত কারণেই। দুই দেশের লিডারদের নির্দেশ আছে নিশ্চয়। না থাকলে, পাকিস্তানি সৈন্যরা কবেই গুঁড়িয়ে দিত। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশপাশের সবাইকে কতল করত। শেখ মুজিব আমাদের বাঁচিয়েছেন। গোটা বাংলাদেশকেও।
বারি ভাইয়ের পরিচয় খুব বেশি নয়। তিনি পাবনা সাধুপাড়ার (দুই কিলোমিটার দূরে আরেকটি পাড়া, নাম 'শয়তান' পাড়া। 'এই পাড়ার অনেকেই রাজাকার' বলতেন)। তার দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনে। বারি ভাইয়ের বড় বোন 'বেগম' এই নামেই সম্বোধিত।
তিনি যুদ্ধের প্রতিদিনের ডায়েরি লেখেন। ২৬ মার্চ (১৯৭১) থেকে। সেই ডায়েরি কী করে লাপাত্তা, হদিস নেই আর।
বেগমবুর ছোট বোন ঝরা, আনিসা আখতার, বিয়ে রশীদ হায়দারের সঙ্গে, পদবি আনিসা হায়দার, আমাদের ভাবি, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে, তারই বড় বোন বেগমবুর বাড়িতে আমরা আশ্রিত। আশ্রয় যতই নিরাপদ হোক, বারি ভাইয়ের নির্দেশে রাতের অন্ধকারে দুটি ট্রেঞ্চ খুঁড়ি, যুক্তি তার 'ট্রেঞ্চে থাকলে, পাকিস্তানি বোমারুরা বোমা ফেললেও আঁকাবাঁকা ট্রেঞ্চে দুই-একজন আহত হলেও বাঁচবে হয়তো।'
১৫ ডিসেম্বর গেল, আকাশ বোমারু বিমানহীন, আমরা মৃতপ্রায়। নিঃশ্বাসও বন্ধ যেন। রাত্রি কাটে নির্ঘুম। সকাল ১০টায় (১৬ ডিসেম্বর) একটি সাদা জিপ ছুটে যায়, মাইকে মহিলার কণ্ঠ 'বেংলাদেশ ফ্রি। বেংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট।'
কী আশ্চর্য, চোখও অবিশ্বাস্য। মহিলার ওই ঘোষণায়, মুহূর্তেই সব বাড়ি থেকে লোকে রাস্তায় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে মশগুল। এ-ও বাহ্য। অনেকের হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন হৃদয়ে না প্রকাশ্যে? এই জনজোয়ার যারা দেখেননি, বলব, 'লস্ট ইয়োর লাইফ।'
উত্তেজনায় এতটাই টগবগে, কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বেগমবুর বাড়ির দোতলা থেকে লাফ দিই। কঁকিয়ে উঠি। পা মচকায়। শুরু হয় ব্যথা। পরোয়া নেই। দেশ স্বাধীন। 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা'।
জগলু কোত্থেকে গাড়ি নিয়ে হাজির। ড্রাইভ করতে জানে। ঠেসেঠুসে গাদাগাদি করে নয়জন উঠি।
সবাই আত্মীয়।
গন্তব্য শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে। লোকে লোকারণ্য। আসলে সব বড় রাস্তায়। বহু মুক্তিযোদ্ধাও এক লহমায় ওখানে। রহস্য। নিশ্চয় ঢাকায় অপারেশনে ছিল। হোটেল পাহারায় বহু ভারতীয় সৈন্য। হোটেলের ভেতরে উঁচু পদের অনেক পাকিস্তানি সেনা অফিসার আশ্রিত। হোটেল তখন 'সেফ জোন'। কিন্তু হোটেলের ছাদে কয়েকজন সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনা। কোনো এক ভারতীয় সেনা মাইকে উর্দুতে ছাদের ওপরে পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশ দিচ্ছেন অস্ত্র সমর্পণের এবং নিচে নামতে। ছাদ থেকে হঠাৎ এলোপাতাড়ি গুলি, রাস্তায় দর্শকের উদ্দেশে। চার-পাঁচজন লুটিয়ে পড়েছে। ভারতীয় সেনাদের মেশিনগানও গর্জে উঠল। পাকিস্তানি সেনারা ছাদের ওপরে শুয়ে পড়ছে। ওদিকে রেডিও পূর্ব পাকিস্তানের (ঢাকা) ছাদে চারজন মুক্তিযোদ্ধা। হাতে বাংলাদেশের পতাকা। পতাকা উত্তোলক মুক্তিযোদ্ধা (শাহাবুদ্দীন আহমেদ। এখন বিখ্যাত বৈশ্বিক চিত্রশিল্পী)। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে দু'জন নিহত। একজন গুরুতর জখম। শাহাবুদ্দীন ছাদে শুয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে একটি খাম্বার আড়ালে। বেঁচে যান। আমরাও বাঁচি রাস্তায় শুয়ে। গোলাগুলি থামার পর বাড়ি ফেরা। রাস্তায় অসম্ভব ভিড়। মুক্তিযোদ্ধারাও আছেন। পুরুষ
নয় শুধু, তরুণী-যুবতীরাও জড়িয়ে ধরছেন মুক্তিযোদ্ধাকে। একজন তরুণী তো এক মুক্তিযোদ্ধার বক্ষলগ্ন হয়ে চুমু খেলেন।
গাড়ি থেকে নামতে হয় একটু দূরে, বাড়ি থেকে দূরে। এক মহিলা বয়স সত্তরের বেশি, আকুতিমিনতি করছেন 'বাবারা আমারে বাংলাদেশের একটি পতাকা দিবা? বুকে রাখুম।' ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে। দুপুরের আগে।


  বার্লিন প্রবাসী কবি