কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান একাত্তরের মার্চে যশোর শহরে নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। পরে তিনি যশোর কোতোয়ালি থানায় অস্ত্র লুণ্ঠনে অংশ নেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়ে লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পান। যশোর অঞ্চলে দায়িত্ব পালনকালে নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি শনবার্গসহ বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে দুই দফা সাক্ষাৎ হয়। শনবার্গের প্রতিবেদনে ও বইয়ে রয়েছে আখতারুজ্জামানের বক্তব্য, বর্ণনা ও আলোকচিত্র। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর যশোরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানে বিরত থাকেন। পরে তিনি টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনে ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০১ সালে অবসরে যান। তার জন্ম ১৯৪৪ সালে যশোরে
সমকাল: আমরা জানি, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গের একাধিক প্রতিবেদন ও বইয়ে আপনার কথা ও ছবি রয়েছে। তিনি মুক্তিবাহিনীর এক 'বাঙালি বিদ্রোহী' কোম্পানি কমান্ডারের কথা লিখেছিলেন।
আখতারুজ্জামান: আমিই শনবার্গের সেই বাঙালি বিদ্রোহী। আমার কথাই তিনি লিখেছেন তার প্রতিবেদনে এবং পরে প্রকাশিত বইয়ে। বইটির নাম 'বিয়োন্ড দ্য কিলিং ফিল্ডস'।
সমকাল: তিনি লিখেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় আপনি প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আখতারুজ্জামান: তার বর্ণনায় সামান্য ভুল আছে। আমি আসলে কমিশন পাব কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কারণ প্রশিক্ষণ শেষে অবাঙালি প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছিল। আমি একটু বিদ্রোহপ্রবণ ছিলাম। বাঙালি নিয়ে কটাক্ষ করায় মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম। এ নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল এবং আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
সমকাল: ২৫ মার্চে কি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হচ্ছে?
আখতারুজ্জামান: যশোরের লোকজন জানত যে, আমি সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ২৫ মার্চ মধ্যরাতেই পুলিশ লাইন্স থেকে একদল বাঙালি পুলিশ সদস্য এসে আমাকে বলেছিল, তারা স্থানীয় এমপি মশিউর রহমানের বাসায় যেতে চায় করণীয় নির্ধারণ করতে। তারা ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আক্রমণের খবর শুনেছে। আমি বলি, নেতারা কেউ বাসায় নেই। সবাই বাসার বাইরে। পরে তারা ফিরে যায়। শহরে তখন সবাই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সমকাল: কী ধরনের প্রস্তুতি?
আখতারুজ্জামান: আলাপ-আলোচনা, করণীয় নির্ধারণ, বাঙালিদের গোপন বার্তা আদান-প্রদান। যেমন তখন ইপিআর শহরে টহল দিচ্ছিল। তাদের একটি টয়োটা জিপ এসে আমার বাসার সামনে হর্ন দিতে থাকে। আমি বের হলে বলে যে, এই গাড়িতে আমরা সবাই বাঙালি অফিসার ও সিপাহি। সবাইকে গোপনে জানিয়ে দেবেন, প্রস্তুত থাকতে। ইপিআর থেকে আমরা যে কোনো সময় বিদ্রোহ করতে যাচ্ছি।
সমকাল: যশোর ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি কী ছিল? সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল?
আখতারুজ্জামান: যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমার কয়েকজন কোর্সমেট ছিল। সেই সূত্রে সেখানকার পরিস্থিতি জানতাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় সেখানকার ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চৌগাছা সীমান্তে ছিল নিয়মিত মহড়ার অংশ হিসেবে। সেখানে বাঙালি সিপাহি ও অফিসারদের হাতিয়ার নিয়ে নেওয়া হয়। ফিরে আসার পর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাঙালি-অবাঙালি প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়।
সমকাল: তখন আপনারা কী করলেন?
আখতারুজ্জামান: যশোর ক্যান্টনমেন্টে গোলাগুলি শুরু হলে আমরা যুদ্ধ শুরুর সংকেত পেয়ে যাই। আমাদের অঞ্চলে তখন চরমপন্থি বাম রাজনৈতিক দলের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাদের কাছে কিছু অস্ত্রশস্ত্র ছিল। সেগুলো নিয়ে আমরা যশোর কোতোয়ালি থানায় অস্ত্র লুট করতে যাই। আমি একটি নতুন থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর সাড়ে তিনশর মতো বুলেট নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমাদের সঙ্গে যোগ দিল বাঙালি ইপিআর সদস্যরা, পুলিশ লাইন্সের পুলিশ সদস্যরা। ইপিআরের কাছে কিছু সিক্স পাউন্ডার কামান ছিল। সেগুলো মোতায়েন করে ক্যান্টনমেন্টের সীমানা ঘেঁষে গোটা শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো।
সমকাল: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই হয়েছিল কবে?
আখতারুজ্জামান: পাঁচ-ছয় দিন পর। ততদিনে শহরের ৯০ ভাগ বাসিন্দা গ্রামাঞ্চলে চলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর কাছে স্বাভাবিকভাবেই ভারী অস্ত্র ছিল। আমরা টিকতে না পেরে যশোর-ঝিনাইদহ রোড ধরে বারোবাজারের দিকে চলে যাই। মান্দারতলা এলাকায় গিয়ে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একটি দলের সঙ্গে দেখা হলো। তাদের অনেকের কাছে অস্ত্র ছিল, কিন্তু গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল। তারা সড়কের দুই পাশে ডিফেন্স নিয়ে অবস্থান করছিল। আমরা কিছু বুলেট ও গোলা-বারুদ দিলাম তাদের। সেখানে কয়েক দিন থেকে আমি আবার শহরে ফিরে এসেছিলাম, পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে।
সমকাল: পরিবারে তখন কে কে ছিল?
আখতারুজ্জামান: আমার মা-বাবা ছিল, ভাই-বোন ছিল। বাবা ভুল চিকিৎসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। রাতের অন্ধকারে শহরে ফেরার পথে পাকিস্তান আর্মির সার্চ পার্টির মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমার কাছে সেই থ্রি নট থ্রি রাইফেলটি ছিল। কোনো রকমে একটি খড়ের গাদায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাই। তাদের নিয়ে কালীগঞ্জের পরমানন্দি গ্রামে চলে যাই। সেখানে আমার নানাবাড়ি ছিল। চিত্রা নদীর পাড়ের ওই গ্রাম প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় নিরাপদ ছিল। সেখানে তাদের রেখে আমি মে মাসে চৌগাছা দিয়ে ভারতের বয়রা সীমান্ত এলাকায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার সঙ্গে দেখা হয়। সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা হয়। দু'জনই তাদের সঙ্গে সেখানে থাকতে বলেন। কিন্তু আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধ করতে চাচ্ছিলাম। জুন মাসের শেষ দিকে কলকাতা চলে যাই।
সমকাল: সেখানে গিয়ে দায়িত্ব পেলেন?
আখতারুজ্জামান: না, সেটা আরেক কাহিনি। থিয়েটার রোডে গিয়ে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করি। বলি বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে চাই, দায়িত্ব দিন। কিন্তু তিনি বারবার জানতে চাইছিলেন এত দেরি করে যোগ দিলাম কেন। তার হয়তো সন্দেহ হয়েছিল আমাকে নিয়ে। এক পর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল এসে আমাকে ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে আটকে রাখে।
সমকাল: আটকে রাখা মানে কী?
আখতারুজ্জামান: মানে একটি ভবনের বাইরে যেতে না দেওয়া। খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রাম। আর ভদ্রভাবে নানা কথা জিজ্ঞাসাবাদ। এক পর্যায়ে সাদা পোশাকের এক ব্যক্তি এসে আমাকে একা ডেকে নিয়ে যান। তিনি সম্ভবত গোয়েন্দা বিভাগের। মাঠে বসে যশোর অঞ্চল সম্পর্কে জানতে চান।
সমকাল: যেমন?
আখতারুজ্জামান: যেমন বেনাপোল থেকে যশোর পর্যন্ত কয়টা নদী, কয়টা ব্রিজ। যশোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান কী, পরিস্থিতি কী ইত্যাদি। আমি বললাম, দেখুন যশোর আমার জন্মস্থান। সবার আগে সেটা আমি মুক্ত করতে চাই। সেদিন থেকে আমাকে বাইরে যেতে দেওয়া হয়, সঙ্গে একজন সিপাহি থাকত। রোজ ২০ রুপি পকেটমানি দেওয়া হতো। ফোর্ট উইলিয়ামে যাওয়ার একুশ দিন পর আমাকে কল্যাণী নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছিলেন মেজর এম এ মঞ্জুর, তিনি পরে আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি আমাকে তার বাহিনীতে নিয়ে নেন।
সমকাল: তারপর কি দায়িত্ব পেলেন?
আখতারুজ্জামান: তিনি আমাকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দিলেন। বেনাপোল সাব সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি সিএসপি অফিসার, মুক্তিযুদ্ধের সময় কুষ্টিয়ার ডিসি ছিলেন। পরে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। তার অধীনে আমাকে নিয়োগ দিয়ে মেজর মঞ্জুর বলেন, যদি যুদ্ধে সাফল্য দেখাতে পারি, তাহলে লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি দেবেন।
সমকাল: সেখানেই তো পুটখালী যুদ্ধ হয়েছিল।
আখতারুজ্জামান: হ্যাঁ, সেই যুদ্ধ আমার প্রথম সম্মুখসমর। যোগ দেওয়ার পরদিন আমি একটি রাইফেল ও একজন সিপাহি নিয়ে নৌকায় করে বেনাপোল থেকে পুটখালীর দিকে যাই। তখন বন্যায় ওই এলাকা ডুবে গিয়েছিল। দক্ষিণ দিকে সিক্রি বটতলা নামে একটি জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কার খুঁড়ে অবস্থান নিয়ে ছিল। আমি সাধারণ পোশাকে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসি। এসে অধিনায়ক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে বিস্তারিত জানাই। ১২ সেপ্টেম্বর আমরা সিক্রি বটতলা আক্রমণ করি।
সমকাল: সেই যুদ্ধের বিস্তারিত বলবেন?
আখতারুজ্জামান: রাত নামলে আমরা বেনাপোল ক্যাম্প থেকে বের হয়ে যাই সাব সেক্টর কমান্ডার তৌফিক-ই-ইলাহীর নেতৃত্বে। পুটখালী পর্যন্ত ভারতীয় বর্ডার রোড দিয়ে গিয়ে ৫-৬টা নৌকায় করে ইছামতী নদী পার হই। আমাদের গাইড ছিল 'কালু ডাকাত'। ওই এলাকা ছিল তার নখদর্পণে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, নদীতে প্রবল স্রোত। আমরা অনেকেই ধূমপান করতাম। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে কোনো সিগারেট জ্বালিনি। কোনো হারিকেনও না। যাতে করে চোখ অন্ধকারে সয়ে যায়। আমরা বাজার থেকে টিনের খেলনা কিনেছিলাম। সেটা টিপ দিলে ব্যাঙের মতো আওয়াজ করত। এটাই ছিল পরস্পর যোগাযোগের সংকেত। অন্যরা শুনলে ভাববে ব্যাঙ ডাকছে।
সমকাল: তারপর?
আখতারুজ্জামান: হাঁটুপানি ভেঙে আমরা সিক্রি বটতলার কাছে একটি ডাঙায় গিয়ে উঠি। পাকিস্তানি বাঙ্কারগুলো রাইফেলের রেঞ্জের মধ্যে ছিল। তিনটি দলে ভাগ হয়ে যাই। একদল আক্রমণ করবে, আরেক দল এগিয়ে গিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেবে। পাকিস্তানিরা বাঙ্কার ছেড়ে পালাতে চাইলে অ্যাম্বুশ করবে। আরেক দল রিজার্ভ থাকবে। কিন্তু রুস্তম নামে এক ইপিআর সদস্য বাঙ্কারের কাছে সেন্ট্রি দেখেই গুলি চালিয়ে দেয় এবং নিজেও নিহত হয়। তার ডেডবডি আনতে গিয়ে আরেকজন নিহত হয়। ফলে সকাল দশটা পর্যন্ত আক্রমণ করেও যুদ্ধে সম্পূর্ণ জয়লাভ করতে পারিনি। এক পর্যায়ে বেনাপোল ফিরে আসি।
সমকাল: জয় না পাওয়ার কারণ কী ছিল?
আখতারুজ্জামান: রাত ৩টার দিকে বাঙ্কারে সাধারণত সবাই ঘুমে থাকে। কিন্তু প্রথমেই সেন্ট্রিকে গুলি করায় তারা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। আর্টিলারি ফায়ার ঠিকমতো করতে না পারায় তাদের বাঙ্কার থেকে তুলে আনতে পারিনি। তবে তারপরও পাকিস্তানি অনেক সেনা হতাহত হয়। কিন্তু আমরা যে এতদূর এগিয়ে আক্রমণ করব, তারা ভাবতেও পারেনি। এই আক্রমণের পর তাদের মনোবল ভেঙে যায় এবং কিছুদিন পর সিক্রি বটতলা থেকে পিছু হটে যায়। এটাও যুদ্ধের জয় ও সাফল্য।
সমকাল: সাফল্যের পুরস্কার পেয়েছিলেন?
আখতারুজ্জামান: হ্যাঁ, আমাকে লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী শিকারপুর চলে যান। আমাকে বেনাপোল কোম্পানি কমান্ডার করা হয়। বেনাপোল থেকে পুটখালী পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর ডিফেন্স লাইন ছিল। আমাকে এটা ক্লিয়ার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সমতলের ডিফেন্স ভাঙা সহজ নয়। আমরা দেশীয় নৌকা নিয়ে ছোট ছোট দলে আক্রমণ করতে থাকলাম। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পুটখালী থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। যশোর থেকে বেনাপোল রোডের বাম পাশের পুরো এলাকা মুক্ত হয়। কয়েকটি ইউনিয়ন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এই অগ্রগতি দেখাতেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিদেশি সাংবাদিকদের সরেজমিন পরিদর্শনে নিয়ে আসে। অক্টোবরের ১০ তারিখ ডেটলাইনে হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় হেডলাইন হয়- 'থ্রি আওয়ার্স ইন বাংলাদেশ'।
সমকাল: সেখানেই তো সিডনি শনবার্গের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ?
আখতারুজ্জামান: হ্যাঁ, সাংবাদিকদের সেই দলেই ছিলেন তিনি। নিউইয়র্ক টাইমসে তিনি পুটখালীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে আমার বক্তব্য প্রকাশ হয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন, মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের পোশাক মলিন ও অস্ত্রশস্ত্র সাধারণ হলেও মনোবলের ঘাটতি ছিল না। আমি বলেছিলাম, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার জন্য যুদ্ধে যোগ দিয়েছি। নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে আমাদের নিয়ে অনেক কথাই ছিল।
সমকাল: সিডনি শনবার্গের সঙ্গে আপনার দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল মুক্ত যশোরের পথে। ৮ ডিসেম্বর ডেটলাইনে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনেও আপনাকে নিয়ে অনেক কথা ছিল।
আখতারুজ্জামান: ঠিকই বলেছেন। আমরা তখন যশোরের দিকে এগোচ্ছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে হটতে ব্রিজগুলো ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল। আমরা ব্রিজগুলো মেরামত করতে করতে এগোচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিল মিত্র বাহিনীর সদস্যরা। প্রথমে নাভারন ব্রিজ মেরামত করি।
সমকাল: নাভারন ব্রিজ মানে বেতনা নদী, তাই না?
আখতারুজ্জামান: একদম ঠিক বলেছেন। গোটা যশোর এলাকা আমার হাতের তালুর মতো চেনা ছিল। যে কারণে ভারতীয় বাহিনী আমার পরামর্শ ছাড়া যশোরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল না।
সমকাল: সিডনি শনবার্গ ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গেই ছিলেন। তার সঙ্গে আপনার দেখা হলো কোন সেতুতে? তিনি সেই নদী নিয়েও আপনার অনেক স্মৃতির কথা লিখেছেন।
আখতারুজ্জামান: সেটা ঝিকরগাছা ব্রিজ। ব্রিটিশ আমলের ব্রিজ ছিল, পাকিস্তানি বাহিনী ভেঙে দিয়ে পিছু হটেছে। তারা পরাজয় নিশ্চিত জেনে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল।
সমকাল: তার মানে কপোতাক্ষ নদী। শনবার্গ লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে আপনি ওই নদীতে জ্যোৎস্না রাতে বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন।
আখতারুজ্জামান: ভুল লিখেছেন, অনুবাদেরও ভুল হতে পারে। আমাদের ছাত্রজীবনে বান্ধবী নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যেতাম নদীটিতে। যাহোক, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী কয়েক দিক থেকে যশোরে ঢুকতে থাকি। চৌগাছা, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর। আমরা ঝিকরগাছায় থাকতে থাকতেই পাকিস্তানি বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে ঢাকার দিকে চলে যায়। আমার ছেলের জন্ম হয় একাত্তরের ২৫ নভেম্বর। কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর সামান্য সময়ের জন্য পরমানন্দি গ্রামে গিয়ে তাকে দেখে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম।
সমকাল: স্বাধীনতার পর আপনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন না কেন?
আখতারুজ্জামান: বিজয়ের পর সেক্টর কমান্ডার আমাকে নড়াইল এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংগ্রহ ও সনদ বিতরণের দায়িত্ব দেন। একটা মিলিশিয়া ক্যাম্প করে এই দায়িত্ব পালন করি। তারপর মোবারকগঞ্জ চিনিকল চালু করার দায়িত্ব পাই, সেটাও মাত্র একুশ দিনে চালু করে দিই। কিছুদিন নড়াইল মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্বও পালন করি। এসব পালন শেষে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ নিজের জিপ ড্রাইভ করে যশোর ফেরার সময় দাইতলা ব্রিজের কাছে দুর্ঘটনায় পড়ি। আমার গাড়িতে ছিলেন নড়াইলের এমপি হাফিজ সাহেবও। রাস্তায় তেল পড়ে ছিল দূর থেকে দেখিনি। গাড়ি স্লিপ করে সড়কের পাশে গড়িয়ে পড়া পর্যন্ত জ্ঞান ছিল। গুরুতর আহত অবস্থায় জ্ঞান ফিরে দেখি যশোর সিএমএইচে। সেখান থেকে 'সেসনা' প্লেনে করে ঢাকা সিএমএইচে, তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ইতোমধ্যে ছয় মাসের বেশি সময় কেটে গেছে। চিকিৎসকরা রাজি না হলেও রিলিজ নিয়ে আবার প্লেনে করে যশোর চলে যাই।
সমকাল: যশোর গিয়ে কী দেখলেন?
আখতারুজ্জামান: আমার বাড়িটা হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা পুড়িয়ে দিয়েছিল, লুটপাট করেছিল। স্টেশন রোডে একটি সরকারি কোয়ার্টার পেলাম। সেনাবাহিনীতে বা রক্ষী বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, শরীরের এই অবস্থায় আর যোগ দেওয়া হয়নি। পরে বিটিএমসিতে ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দিই।
সমকাল: সিডনি শনবার্গের সঙ্গে পরে আরও দেখা হয়েছিল?
আখতারুজ্জামান: না, আর হয়নি। ঢাকা সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের ওই কয়েকটি সংখ্যা, তার সঙ্গে আমার তোলা ফটোগুলো ডাকে পাঠিয়েছিলেন। ভারতীয় পত্রিকাগুলোও পেয়েছিলাম। সেগুলো এখনও স্মৃতি হিসেবে আছে।
সমকাল: স্মৃতিকথা লিখুন।
আখতারুজ্জামান: অনেক কথা লেখা যাবে না। আমরা যে উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলাম, তারও অনেক প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য দূর হয়নি। আবার অনেক কথা ভুলেও যাচ্ছি। আমার বাইপাস সার্জারি হয়েছে, ওষুধের প্রভাবে স্মৃতিও ধূসর হয়ে আসছে। কিন্তু শনবার্গের সঙ্গে স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের এক মহান বন্ধু।
সমকাল: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আখতারুজ্জামান: সমকালকেও ধন্যবাদ, প্রায় বিস্মৃত একটি বিষয় তুলে ধরার জন্য।

বিষয় : আমিই শনবার্গের সেই 'বিদ্রোহী বাঙালি'

মন্তব্য করুন