সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবিভক্ত গ্রামবাংলার তাঁতশিল্পীদের বোনা মসলিন তৎকালীন ব্রিটিশ অভিজাত পরিবারের আভিজাত্যের ফ্যাশনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কালের গর্ভে বিস্মৃত হয়ে গেছে গ্রামবাংলার তাঁতশিল্পীদের গৌরবময় ইতিহাস। বিলুপ্ত তন্তু বা সুতা দিয়ে তৈরি মসলিন ড্রেস এখন আর পরিধেয় বস্ত্র নয়। ইতিহাসের গবেষণার বিষয়ে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই আমরা দেখি, তিন শতাধিক বছর পরে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে পূর্ব লন্ডনে হেরিটেজ প্রজেক্ট বেঙ্গল টু ব্রিটেন :রিয়েক্রিয়েটিং হিস্টোরিক ফ্যাশনস অব দি মুসলিম ট্রেড নামে এক প্রকল্প কাজ করছে। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া পথচলা এই হেরিটেজ প্রজেক্ট মসলিনের ওপর তাদের কাজ শেষ করেছে ২০১৯ সালে। এই প্রজেক্টে লন্ডনের ফ্যাশন ডিজাইনাররা ঐতিহাসিক মসলিন দিয়ে অতীতে বানানো কিছু ড্রেস রিক্রিয়েট করেছেন ঢাকার জামদানি কারিগরকে দিয়ে। হেরিটেজ প্রকল্পে জড়িত ডিজাইনার ও সংগঠকদের কাজের সচিত্র বিবরণ নিয়ে স্টেপনি কমিউনিটি ট্রাস্টের উদ্যোগে হেরিটেজ প্রজেক্ট ইংরেজিতে একটি তথ্যসমৃদ্ধ বই আকারে স্মরণিকাও প্রকাশ করেছে। বইটি সম্পাদনা করেছেন হেরিটেজ ফ্যাশন রিয়েক্রিয়েটর্স এবং ডিজাইন করেছেন সাইফ ওসমানি। হেরিটেজ প্রজেক্টের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ছিল পল্লিবাংলার তাঁতশিল্পীরা যে একদিন বিশ্ব জয় করেছিলেন, তাদের সৃজনশীল শৈল্পিকতা দিয়ে তা আবার পুরুজ্জীবিত করা।

বর্তমানে মাইগ্রেন্টসদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে সৃজনশীল কিছু কাজকর্ম চলছে স্টেপনি কমিউনিটি ট্রাস্টের হেরিটেজ প্রজেক্টের মাধ্যমে। ২০১০ সালে মোহাম্মদ আহমেদ উল্লার নেতৃত্বাধীন ব্রিকলেন সার্কেল গ্রামবাংলার বিলুপ্ত মসলিনের ওপর এক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। তারা তাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে ফ্যাশন জগতের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশন, সংশ্নিষ্ট কমিউনিটি সংগঠন ও পেশাদার ফ্যাশন ডিজাইনারদের জড়িত করেন।

তারা ঢাকার রূপগঞ্জের জামদানি শিল্পী আবু মিয়ার সাহায্য নিয়ে লন্ডনের ফ্যাশন ডিজাইনাররা ঐতিহ্যবাহী জামদানি দিয়ে তাদের ডিজাইনকৃত ড্রেস বানিয়ে নিয়ে আসেন। গৌরবের এই মসলিনের উত্তরাধিকারীরা এখনও কিন্তু হাল ছাড়েননি। গ্রামবাংলার তাঁতিরা জামদানি, খাদি ও মণিপুরি বস্ত্রশিল্প এখনও বুনন করে যাচ্ছেন। ফ্যাশন ফল ডেভেলপমেন্টের উদ্যোক্তা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল তাঁত বস্ত্রের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারে নিরলস কাজ করে চলেছেন।

স্টেপনি কমিউনিটি ট্রাস্টের হেরিটেজ প্রজেক্ট মসলিনের ওপর কাজ করতে গিয়ে ৭০ দশকের লন্ডনের হোম মেশিনিস্টদের ওপর ও ওরাল হিস্ট্রির একটি প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছেন।

ভুলে যাওয়া লন্ডনের হোম মেশিনিস্ট : বাংলাদেশে তাদের পাঠানো ফরেন কারেন্সি আগেই বলেছি স্টেপনি কমিউনিটি ট্রাস্ট ও হেরিটেজ প্রজেক্ট সত্তর দশকের হোম মেশিনিস্টদের কাহিনি ও ওরাল হিস্ট্রির মাধ্যমে ধরে রাখার প্রয়াস নিয়েছেন।

১৯৬০ সালের শেষের দিক থেকে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইস্ট লন্ডনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নারী-পুরুষের এক বিরাট জনগোষ্ঠী গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিক হিসেবে জড়িয়ে পড়েছিল। এই শ্রমিকগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ ছিল বাঙালি নারী এবং এসব নারী বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে আসা, গৃহবধূ হিসেবে সংসারের কাজকর্ম করার পাশাপাশি রাত জেগে তারা সেলাই মেশিনে কাজ করতেন। ব্রিটেনে বসবাসরত দক্ষ-অদক্ষ হোম মেশিনিস্ট নারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ দিয়ে তাদের স্বামীরা ব্রিটেনে পারিবারিক সদস্যদের অর্থায়নে প্রপার্টি কিনেছিলেন, রেস্টুরেন্ট ও গ্রোসারি শপ কিনেছিলেন।

ব্রিটেনে বাংলাদেশ থেকে আসা দক্ষ-অদক্ষ পুরুষ ও নারী শ্রমিক তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে ব্রিটেনে যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, এই মডেল নিয়ে আজও কোনো গবেষণা হয়নি। গ্রামীণ বা ব্র্যাক বাংলাদেশে যে ক্ষুদ্র ঋণ বা মাইক্রো ফাইন্যান্স পদ্ধতি চালু করেছে, ব্রিটেনের সিলেটি বাঙালিরা ব্যাংক ঋণ না নিয়েও নিজেদের মধ্যে গ্রুপ সৃষ্টি করে রেস্টুরেন্ট, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বা গ্রোসারি শপ প্রতিষ্ঠা করে ভালো ব্যবসা করেছিলেন। গ্রুপ সৃষ্টি করে তারা প্রপার্টি ব্যবসাও করেছেন, পরে বাংলাদেশে চা বাগান, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, রিয়েল এস্টেট, হাসপাতাল, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি, ইউনিভার্সিটিতেও গ্রুপ নিয়ে ইনভেস্ট করেছেন। যদিও আলাদাভাবে গবেষণা করে পাকিস্তান আমলে আসা সিলেটি বাঙালিদের এই অর্জন নিয়ে গবেষণা হয়নি। তবে এই মানুষগুলোর অবদান উল্লেখ করতেই হবে। আশার কথা, এই লন্ডনে ও বাংলাদেশে তাঁতশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। সিলেটের মণিপুরি তাঁতশিল্পের উন্নয়নে কাজ করার আগ্রহ নিয়ে রিভাইভিং হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হ্যারিটেজ- ঐতিহ্যের তাঁতের যাত্রা শুরু হয়েছে। নারীদের দারিদ্র্য মোচনের জন্য এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য জাস্ট হেল্প ফাউন্ডেশন ইউকে এবং বিবি ফাউন্ডেশন লন্ডন নামে দুটি নন-প্রফিট মেকিং সামাজিক সংগঠন সিলেটে রিভাইভিং হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হ্যারিটেজ বা ঐতিহ্যের তাঁত নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু করেছে।

সম্ভাবনাময় মণিপুরি তাঁত বস্ত্রকে দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় এবং ব্যবসা সফল করে তুলতে হলে ফ্যাশন ও ডিজাইনে আধুনিকতা আনতে হবে। বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। গ্রামীণ নারীরা যারা তাঁত বস্ত্র উৎপাদন করছেন, তারা যাতে প্রকৃত মজুরি হাতে পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব গ্রামীণ নারী পরিবেশবান্ধব বস্ত্র উৎপাদন করছেন, কাজেই তাদের পণ্যকে অগ্রাধিকার দিলে তারাও বাঁচবেন এবং এই শিল্পটাও বাঁচবে। মণিপুরি তাঁতশিল্পের বিরাট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই শিল্প কেন পিছিয়ে পড়ে রয়েছে এর কারণ খুঁজে বের করাও প্রয়োজন। জামদানি, খাদি, বুটিক শিল্পের পাশাপাশি বৃহত্তর সিলেটে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা মণিপুরি বস্ত্র শিল্পকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা নয়, এই বস্ত্র শিল্পকে ব্যবসা সফল করার জন্যও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

চলমান কভিড-১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বিশ্বকে বাঁচাতে হলে পরিবেশবান্ধব হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অন্ন, বস্ত্র খাতে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প পরিবেশবান্ধব এই কুটিরশিল্পকে শক্তিশালী করতে হবে।

লন্ডনের স্টেপনি কমিউনিটি ট্রাস্ট মসলিন নিয়ে হ্যারিটেজ প্রজেক্ট যেভাবে ঢাকা ও লন্ডনে কাজ করেছে, তাদের সঙ্গে যদি রিভাইভিং হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হ্যারিটেজ- ঐতিহ্যের তাঁত টুইনিং করতে পারে, তাহলে বাংলার লুপ্তপ্রায় তাঁতশিল্প আবার আলোর মুখ দেখতে পারবে।

লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক

বিষয় : নজরুল ইসলাম বাসন ক্ষুদ্রশিল্প

মন্তব্য করুন