ভাস্কর্য নিয়ে যে হুঙ্কার দিয়ে রাজনৈতিক ধর্মবাদীরা মাঠে নেমেছিল, সারাদেশে তার প্রতিক্রিয়া দেখে তারা কিছুটা স্তিমিত হয়েছে কিন্তু তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। বরং তারা ভাস্কর্যবিরোধী ফতোয়া দিয়ে কিছু করে ফেলতে পারবে বলে মনে করে। কুষ্টিয়ায় দুই মাদ্রাসাছাত্র দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্যের ক্ষতিসাধন করার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে। অবশ্য তাদের এই ধৃষ্টতা নতুন নয়। ২০১৩-এর ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতের ডাকা সমাবেশ থেকে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে উদ্দেশ করে বলেছিল, পরদিন তিনি কোথা দিয়ে পালাবেন সে ব্যবস্থা দেখতে। তারা এ ব্যাপারে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া থেকে সাহস পেয়েছিল। কিন্তু পরদিনের প্রয়োজন পড়েনি, ওই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত না হতেই তারা বরং শাপলা চত্বর এলাকা ছেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য ওই সমাবেশ চলাকালে তারা আশপাশ অঞ্চলের বিভিন্ন সরকারি অফিস, গাড়ি, দোকান, বিশেষ করে বায়তুল মোকাররমের বন্ধ সোনার দোকান লুট করার জন্য ভাঙচুর করেছিল। পল্টনের কমিউনিস্ট পার্টি অফিস আক্রমণের চেষ্টা নিয়েছিল। হেনস্তা করেছিল একজন নারী সাংবাদিককে। বিশেষ করে সবচেয়ে যে গর্হিত কাজটি তারা করেছিল, তা হলো বায়তুল মোকাররমের সামনের ইসলামী বইয়ের দোকান পুড়িয়ে দেওয়া, যার মধ্যে কোরআন-হাদিস ছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে পরদিন ওই এলাকা পরিদর্শনে গেলে আমি অসংখ্য পোড়া কোরআন, হাদিসসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ দেখেছিলাম।

এসব রাজনৈতিক ধর্মবাদীরা অবশ্য এতে কোনো অনুতাপ প্রকাশ করেনি। বরং উল্টো শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছিল। তারা দাবি করেছিল, তাদের কয়েকশ 'আলেম'কে হত্যা করা হয়েছিল। তারা এ নিয়ে মোবাইলে দু-তিনটি ভিডিও প্রচার করেছিল, যাতে দেখানো হয়েছিল, শাপলা চত্বরে লাশের স্তূপ পড়ে আছে। পরবর্তী সময়ে যে সত্যটি আবিস্কৃত হয়েছিল তা হলো, ওই ছবিগুলো ছিল আফ্রিকার রুয়ান্ডা অথবা সে ধরনের কোনো একটি দেশে গোত্র সংঘাতের ঘটনায় মৃতদেহের ছবি। তাদের হয়ে 'অধিকার' নামের একটা মানবাধিকার এনজিও ৬৪ বা ৬৮ জন নিহতের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছিল। পরে প্রমাণিত হয়েছিল ওইসব নাম-ঠিকানায় কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। এর জন্য অধিকারের কর্মকর্তাদের সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে ভালো হেনস্তা হতে হয়েছিল। কিন্তু সেই মিথ্যা হেফাজতিরা এখনও প্রচারে রেখেছে এবং তার দ্বারা নতুন প্রজন্মকেও বিভ্রান্ত করছে। তার প্রমাণ ইউটিউবে প্রচারিত 'ডাকসু'র সাবেক ভিপি ও ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হকের শাপলা চত্বরে ওই ঘটনাকে 'গণহত্যা' বলে পুনর্ব্যক্ত করার বক্তব্যে। ছাত্র ঐক্য পরিষদের আরেক অংশ তাদের ভাস্কর্য-সংক্রান্ত বিবৃতিতে 'আলেম-ওলামা'দের বিরুদ্ধে কটূক্তি না করার অনুরোধ জানিয়েছে। সেই আলেম-ওলামারা যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার অথবা টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে ফেলার কথা বলে তখন তাদের কী ভাষাতে জবাব দিতে হয় সে কথা বলেনি। আসলে এসব ধর্মবাদীর এ ধরনের আস্ম্ফালন মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীই নয়, সংবিধানবিরোধীও বটে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগ-এর ৪ (ক) ধারায় এ সম্পর্কিত সুস্পষ্ট বিধান আছে। অবশ্য যে পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে এ বিধান সংযোজন করা হয়, সেই সংশোধনীতে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের বিধিতে কর্তিত রাষ্ট্রের করা মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অবিকৃতভাবে পুনঃস্থাপন করায় তারা এই সংবিধান ও সংশোধনীকেও বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া ও ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার কথা বলেছিল।

ভাস্কর্য বিতর্ক প্রসঙ্গে এ কথাগুলো বলা প্রয়োজন হলো এ কারণে যে, হেফাজত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তথা সামগ্রিক ভাস্কর্য নিয়ে যে কথা বলেছে, তা আকস্মিক কোনো বিষয় নয় অথবা দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে সে কারণেও নয়, তাদের লক্ষ্য পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং এর পেছনে যে জামায়াত পরিপূরকভাবে রয়েছে তার প্রমাণ হাটহাজারী মাদ্রাসা ও হেফাজতের ওপর তাদের দখলদারিত্ব কায়েমের ঘটনা। সেই দখলদারিত্ব কায়েমের পরপরই তারা এসব আলেম-ওলামাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সম্পর্কে হুঙ্কার দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। না হলে তারা যখন বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় জোটের সরকারে ক্ষমতায় ছিল তখন চন্দ্রিমায় বা চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনে আপত্তি করেনি। এসব ভাস্কর্য এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তাতে বোঝা যায়, জিয়াউর রহমান অথবা পাকিস্তানে জিন্নাহ অথবা ইকবালের ভাস্কর্যে তাদের আপত্তি নেই। আপত্তি বঙ্গবন্ধুর বেলায়। লালন- যার মরমী গানে যেমন ধর্মের কথা আছে, তেমনি আছে মানবধর্মের কথা, তাদের সম্পর্কে। এমনকি যে তুরস্ককে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার দাবি জানানোয় বিশেষ বন্ধু বলে মনে করে, সে দেশের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্যে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা সে দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য কেন স্থাপন করবে, সে নিয়ে আপত্তি করে বহুদিন পর গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিবৃতি দিয়েছে।

যে কথা বলছিলাম, এই ভাস্কর্য বিতর্ক পুরোপুরিই রাজনৈতিক এবং এটা করা হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন সারাদেশ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করছে। দেশ প্রস্তুত হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের জন্য। বাংলাদেশের যে স্বাধীনতাকে তারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে চরম বাধা দিয়েছিল, তার জন্য গ্রামগঞ্জ জ্বালিয়ে দিতে, নারী ধর্ষণ করতে ও করাতে সহায়তা করতে তারা এতটুকু বিচলিত বোধ করেনি, বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া সেই বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হবে, তার জন্য দেশের মানুষ আনন্দ করবে এটা তাদের সহ্য নয়। বরং চারদলীয় জোটের সরকারের মাধ্যমে যেমন, তেমনি আরেক দফা বাংলাদেশকে তার মূল থেকে উৎপাটন করে দেশকে একটি মৌলবাদী-ধর্মবাদী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা সে চেষ্টাটাই এর মাধ্যমে তারা করে দেখতে চেয়েছে। এই সুযোগে তারা অন্য ইসলামী দলগুলোকেও ধর্মের বিধানের দোহাই দিয়ে সঙ্গে পেতে চেয়েছে। এ কারণেই সম্ভবত রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নায়েবে আমির চরমোনাইয়ের পীর সাহেবও তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন। তিনি বা তার অনুসারীরা হয়তো খেয়াল করেননি যে, হেফাজত-জামায়াতের এই তথাকথিত আলেমরা পীরদের খানকা, মাজার ভেঙে দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। এতে সিলেটের হজরত শাহজালাল, শাহপরাণ, চট্টগ্রামের বায়েজীদ বোস্তামী, শাহ আমানতের মাজারসহ বারো আউলিয়ার মাজারের কী হবে। চরমোনাই বা শর্ষীনাসহ বিভিন্ন পীরের খানকা বা আস্তানার কী হবে।

আসলে এ দেশে ওহাবি মতবাদ প্রতিষ্ঠায় তারা সুফিবাদী ধর্মীয় আদর্শসহ বিভিন্ন তরিকার আদর্শকে গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে দিতে চায়। এ কারণেই এতদিন হেফাজতের আমির আহমদ শফীকে ব্যবহার করে তাকে অপমান করার মাধ্যমে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে তারা দ্বিধা করেনি। এই অভিযোগ আমার নয়, মাওলানা শফীর ছেলের।

এ দেশের সুন্নি জামাত-সুফিবাদীরাসহ বিভিন্ন তরিকার মুসলমানদের একই অভিযোগ। তবে তারা এই মুহূর্তে ভাস্কর্য বিতর্কে জড়াননি। কারণ তাদের অভিমান যে, তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হলেও সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় হেফাজতকে কোলে টেনেছেন। তার সঙ্গে জামায়াতিরা সুবিধা করে নিয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারে তাদের নেতাদের ফাঁসি দেওয়ায় তারা যে এই সরকারকে যেকোনো সুযোগে উৎখাত করতে গোপনে তাদের মাধ্যমে সংগঠিত হচ্ছে, সেটা সম্ভবত হিসাবে আসেনি।

পৃথিবীর মুসলিমপ্রধান সব দেশেই ভাস্কর্য আছে। এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। এ ব্যাপারে লালনের ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার পর ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ যে লেখা লিখেছিলেন তার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এই স্বল্প পরিসর লেখায় তার পুনরাবৃত্তি করব না। তবে ধর্মীয় যুক্তি দিয়ে প্রত্যক্ষ উদাহরণ দিয়েও তাদের বোঝানো যাবে না, তারা তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনে আজ ভাস্কর্য, পরদিন শিক্ষানীতি, পরদিন নারীনীতি অর্থাৎ যা কিছু অগ্রসর চিন্তার, যা কিছু প্রগতির তার বিরুদ্ধাচার করবে। লক্ষ্য একটাই, সেটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আদর্শকে উল্টে দিয়ে দেশে মৌলবাদী শাসন কায়েম করা। পাকিস্তানের মতো ইসলামী প্রজাতন্ত্র করা। তাই এ ক্ষেত্রে তারা এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, তার ভাস্কর্যকে বেছে নিয়েছে, সময়ও বেছে নিয়েছে মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে। বিএনপি-জামায়াতের মৌলবাদী শাসন উচ্ছেদ করে এদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরানো গেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার করে পালের গোদাদের ফাঁসি দেওয়া গেছে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ পরাজিত করা যায়নি। এই মুহূর্তের কাজ তাই রাজনৈতিকভাবে এদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করা। তাতে রাষ্ট্রকে সংবিধান, আইন রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি এই অপশক্তির বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে এগোতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক কোনো ধর্মীয় ইস্যু নয়, রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিকভাবেই একে মোকাবিলা করতে হবে।

সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি