করোনার টিকা সুষম বণ্টনে নাগরিক সমাজ যে আহ্বান জানিয়েছে, তার সঙ্গে কারও দ্বিমতের অবকাশ থাকতে পারে না। অস্বীকার করা যাবে না যে, বৈশ্বিক প্রভাবশালী পক্ষগুলোর মধ্যে নানা বিবেচনায় 'দুর্লভ' এই টিকা নিয়ে প্রবল প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা দেখেছি, এরই মধ্যে কয়েকটি দেশে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলো বিপুল পরিমাণে অগ্রিম প্রতিষেধক কিনে নিচ্ছে। অথচ করোনা থেকে মুক্তি পেতে ধনী-দরিদ্র সব দেশেই ভ্যাকসিনের সমবণ্টন নিশ্চিত করা জরুরি। সে জন্য টিকাপ্রাপ্তি প্রাধিকার নির্ধারণে বৈষম্য দূর করা ও মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা প্রয়োজনীয়। মানবজাতির ইতিহাসে এত বিস্তৃত মহামারি যেমন আসেনি, তেমনই এত বড় 'বাজার' আগে কখনও দেখা যায়নি।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিষয়টি নিছক প্রতিযোগিতা ও মুনাফার নয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণেও সব দেশের একই সঙ্গে টিকা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি করোনার টিকাকে যথার্থ অর্থেই বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। আশার খবর হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বহুল প্রতীক্ষিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার নিরাপদ ও কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্থ্য সংস্থাও আগামী বছরের শুরুতেই কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় গরিব দেশগুলোকে টিকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশে আগামী মে-জুনের মধ্যে সাড়ে চার কোটি মানুষের জন্য টিকা আসবে বলে সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব যে খবর দিয়েছেন, তা-ও আশাব্যঞ্জক। তবে মনে রাখা দরকার, কভিড টিকা কর্মসূচি একটি মহাযজ্ঞ। এর জন্য আমাদের প্রস্তুতির বিষয়টিও এসেছে রোববার 'কভিড-১৯ টিকা বাংলাদেশে কে, কখন, কীভাবে পাবে' শিরোনামে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংলাপে বিশিষ্টজনের বক্তব্যে।
এ জন্য তারা তথ্যপ্রবাহে স্বচ্ছতা, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহি নিশ্চিত করার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা-ও যথার্থ। আমরা মনে করি, টিকা দেওয়ার আগেই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। টিকা পরীক্ষার জন্য কারা অগ্রাধিকার পাবে, কোন টিকা বাংলাদেশের জন্য যথোপযুক্ত এবং সহজে সংরক্ষণযোগ্য, তা-ও যাচাই করা জরুরি। টিকা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির জনবলকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব যে তাগিদ দিয়েছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি, করোনার টিকা দ্রুত পাওয়া যতটা জরুরি, তার চেয়েও বেশি জরুরি এর কার্যকারিতা ও যথার্থতা। একই সঙ্গে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কিংবা দুর্নীতিও প্রত্যাশিত নয়। তবে টিকা পাওয়ার আগে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষায় সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও করোনা পরিস্থিতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে আসেনি। উপরন্তু, এরই মধ্যে শীতের কারণে করোনার প্র্রাদুর্ভাব আরও বেড়েছে।
শীতের আগে থেকেই বেশ কিছু দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও পুনরায় লকডাউনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং আমাদের সতর্কতার বিকল্পও নেই। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী 'নো মাস্ক নো সার্ভিস' নীতি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। আমাদের প্রত্যাশা, বৈশ্বিক এ দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রতিটি দেশ যেমন নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষায় মনোযোগী হবে, তেমনি অন্যদের ব্যাপারেও উদ্যোগী হবে। উন্নত দেশগুলো যেভাবে দ্রুত এ ভাইরাসের টিকা নিচ্ছে, তেমনি অন্যরাও যাতে পেছনে পড়ে না যায়, সেদিকেও বিশ্ব নেতৃত্বের দৃষ্টি রাখা চাই।
আমরা দেখেছি, করোনা এমনই এক ভাইরাস, যেটি দেশ-কাল-পাত্র কিছুই মানেনি; বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে এটি বিপর্যস্ত করেছে, তেমনি উন্নয়নশীল বিশ্বও এর ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি; এমনকি ধনী-গরিব নির্বিশেষ সবাই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ভাইরাসটি সংক্রমণের ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো ভেদাভেদ মানেনি, স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিষেধক বণ্টনেও বৈষম্য প্রত্যাশিত নয়। গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্ব গ্রামের অভিন্ন মানুষ হিসেবে করোনার টিকার মাধ্যমেই সবাই প্রমাণ করুক- 'সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।'
মন্তব্য করুন