রাজনীতি থেকে কি সমাধান আসবে না?
নির্বাচন

আবু সাঈদ খান
আবু সাঈদ খান
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:০৫ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:২২
ভূতের পা নাকি পেছনে। সে পেছনে হাঁটে, অন্ধকারের দিকে যায়। মানুষের পা সামনে। সে সামনে হাঁটে, আলোর পথে ছোটে। বাংলাদেশের মানুষের সামনে এখন দুটি পথই খোলা– অন্ধকারের দিকে হাঁটা, না আলোর পথে ছোটা।
মানুষ কষ্টে আছে; স্বল্প আয়ের মানুষ দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। চাল, পেঁয়াজ, আলু, সবজির দাম লাগামহীন হলেও তার সুফল উৎপাদক পাচ্ছে না; পকেট ভরছে মধ্যস্বত্বভোগীদের। এই সুবিধাভোগীদের হাতেই রাজনীতি। সরকারের মধ্যে কারও কারও সদিচ্ছা থাকলেও তারা অসহায়। একদা আমজনতা ভোটের জন্য অপেক্ষা করত। গর্ব করেই বলত, নেতারা ভোটের সময় আসবে না? তখন ধরব। এখন আর সেই ধরাধরির সুযোগ নেই। জনগণ এখন শুধু নামেই দেশের মালিক।
আমরা জানি, রাজনীতিই অর্থনীতির নিয়ম-কানুন ঠিক করে। তাই রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতিও ঠিক হবে না। দেশে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্ত– তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা। কাজটা সহজ নয়, তবে জরুরি।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। অবশিষ্ট আসনগুলো ছিল ভোটারবিহীন। ওই নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। অংশগ্রহণকারী মহাজোটই ছিল সরকার ও বিরোধী দল। ২০১৮ সালে সেই নির্বাচন-প্রহসন থেকে বেরিয়ে আসবার সুযোগ হয়েছিল। সব দল অংশও নিয়েছিল। শেষপর্যন্ত নির্বাচনটি প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। যে কারণে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কণ্ঠেও শোনা গেছে– আগামীতে ’১৪ ও ’১৮ সালের মতো নির্বাচন হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও একাধিকবার বলেছেন, আগামীতে দিনের ভোট রাতে হবে না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ২০১৪ সালের মতো দেশকে আবারও একতরফা নির্বাচনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা তারই আলামত।
বিগত দিনের রেকর্ড বলে, বিএনপি ধোয়া তুলসীপাতা না। তাদের আমলেও ভালো ভোট হয়নি। বিএনপির শাসনামলে নীল নকশার নির্বাচন হয়েছে। কোথাও কোথাও ধানের শীষে ১শর মধ্যে ১১০ ভোট পড়েছে। তখন থেকেই বিরোধী দলের নেতাদের কেনাবেচা শুরু হয়েছে। জেনারেল এরশাদের সময় এলো হোন্ডা মন্ডা গুন্ডার কথা, ভোট ডাকাতি, পাতানো নির্বাচন ইত্যাদি। পাকিস্তান আমলে কারচুপি, ভোট চুরির গল্প শুনেছি। একজনের ভোট আরেকজন দিত; ধরা পড়লে জরিমানা হতো। ভোট ডাকাতি, ভোটের বাক্স ছিনতাইয়ের কথা শুনিনি।
১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচন হয়। ১৯৪৬ সালে হয় সারা ভারতে নির্বাচন। সে সময়ের পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি; ভোট কেলেঙ্কারির তথ্য পাইনি। পাকিস্তানে ১৯৫৪ ও ’৭০ সালে নির্বাচন হয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছি। নির্বাচনের ফল পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনা তখন ঘটানো যেত না।
কিন্তু এ লজ্জা রাখব কোথায়– ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে যা সম্ভব হলো, এখন তা করা সম্ভব হচ্ছে না! দেশে ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। এখন আমজনতার চাওয়া ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা। আমরা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে চাই; ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়িতে ফিরে আসতে চাই। আমাদের ভোটের রায়ে যেন সরকার গঠন হয়, বিরোধী দলের অবস্থানও ঠিক হয়। আর অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট দলীয় সরকারের মাধ্যমে সম্ভব নয়; তা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি, যে সরকারই হোক না কেন।
২৮ অক্টোবরের দিকে চোখ ফেরানো যাক। সৃষ্ট পরিস্থিতির পেছনে বিএনপিরও দায় আছে। ২০১৩-১৪ সালে আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াওয়ের পথ ধরেছিল। তবে তারা যত সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি ঘটনার দায় তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগের আত্মকোন্দলে সে রহস্য এখন উন্মোচিত।
এটি ঠিক যে, এক বছর ধরে বিএনপি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করে আসছিল; জনগণকে কাছে টানতে চাইছিল। সরকারি দলও পাল্টা ‘শান্তি সমাবেশ’ করছিল। যুক্তি একটাই– বিরোধী দল বিশৃঙ্খলা করলে তারা মোকাবিলা করবে। আমরা বলেছি, একই দিনে পাল্টা কর্মসূচি ঠিক না। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে পুলিশ আছে; অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তারপরও আওয়ামী লীগ পাশাপাশি শান্তি সমাবেশ করে গেছে।
২৮ অক্টোবর বিরোধী দলের মহাসমাবেশের আগে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছিলেন, বিরোধী দলের খারাপ উদ্দেশ্য আছে। তারা বসে পড়বে, আর উঠবে না। অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়ে দিলেন– তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবেন। লোকজন সভাস্থলে বসে থাকবে না; সমাবেশ শেষ হলে চলে যাবে। তিনি কর্মীদের খালি হাতেই আসতে বললেন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কর্মীদের লাঠি হাতে আসতে বললেন। ‘খেলা হবে’ বলে বলে উত্তেজনা ছড়ালেন। দেশজুড়ে আতঙ্ক তৈরি হলো।
পুলিশ বিএনপির সভাস্থলের অনুমতি দিতে বিলম্ব করল। ইন্টারনেট বন্ধ রাখল। তা সত্ত্বেও ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটেছিল। নয়াপল্টনের সমাবেশের এক প্রান্ত কাকরাইলের নাইটিংগেলের মোড় ছাড়িয়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের সড়ক পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল।
সব সংবাদমাধ্যমের খবর– তখন আওয়ামী লীগের সভায় আগতদের তিনটি গাড়ি স্লোগান দিতে দিতে প্রধান বিচারপতির বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে পৌঁছাল। স্লোগান-পাল্টা স্লোগান, সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ঢুকে পড়ে; সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে একজন পুলিশ ও একজন যুবদল নেতা নিহত হন। এটি নিন্দনীয় ব্যাপার। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানাই।
প্রশ্ন হলো, পুলিশ কেন এ পথে আওয়ামী লীগের কর্মীদের তিনটি গাড়ি ঢুকতে দিল? তাদের অন্য পথে ঘুরিয়ে দেওয়া কি সংগত ছিল না? তার চেয়ে বড় কথা, পুলিশ কেন বিএনপি কর্মীদের ধাওয়া করে টিয়ার গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে নয়াপল্টনের দিকে অগ্রসর হলো? তাদের দায়িত্ব হলো– সভার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; সভা পণ্ড করা নয়।
২৮ অক্টোবরের ঘটনায় রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ পথে এগোতে চাইছিল। এখন হরতাল-অবরোধের পথে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে পুলিশ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। দেশজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। বিরোধী দলের কর্মীদের আর রাস্তায় দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এসবের মধ্য দিয়ে সরকার কী বার্তা দিচ্ছে? বিএনপিকে কি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে ঠেলে দিতে চাইছে?
রাজনীতিতে সাধারণত একই ঘটনা দু’বার ঘটে না। ঘটলেও দ্বিতীয়বারে তা প্রহসনে পরিণত হয়। একবাক্যে বলা যায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আর হবে না। এমন চেষ্টায় সংঘাত-সহিংসতা আরও বাড়বে, যা কোনো শান্তিপ্রিয় মানুষের কাম্য হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আমি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে সভাসদদের উদ্দেশে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের সংলাপের কয়েকটি লাইনের মর্মার্থ অনুধাবনের অনুরোধ জানাই। তা হলো, ‘আজ বিচারের দিন নয়, সৌহার্দ স্থাপনের দিন। অন্যায় আমিও করেছি, আপনারাও করেছেন, খোদাতালার কাছে কে বেশি অপরাধী– তা তিনিই বিচার করবেন।’ সংলাপটির মর্মবাণী এই যে, নবাবও ভুল করেছেন, সভাসদরাও ভুল করেছেন। এখন ভুলের পুনরাবৃত্তি নয়, সবকিছু ভুলে সৌহার্দ গড়তে হবে।
রাজনীতিকদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, আর ভুলের পুনরাবৃত্তি নয়, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ নয়। আজ সৌহার্দ স্থাপনের দিন। এক টেবিলে বসে ভোট ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আলোচনা করতে হবে।
সময় বয়ে যাচ্ছে। আর দেরি নয়, সংলাপ শুরু করুন এখনই। বলা বাহুল্য, সেই উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে; দলীয়ভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার মোহ ছাড়তে হবে।
আবু সাঈদ খান: বীর মুক্তিযোদ্ধা;
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল