
দেশে কৃষিজমি যে বাড়ছে না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথাটা প্রায়ই মনে করিয়ে দেন। তার ভাষায়, 'দেশের লোকসংখ্যা বাড়তেই থাকবে। সেই সঙ্গে খাদ্যের উৎপাদনও বাড়াতে হবে।' কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- জমির পরিমাণ ঠিক সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কৃষি গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিকল্পিত শিল্পায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দুই ফসলি বা তিন ফসলি জমি কোনোভাবেই এ কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অন্য জমিগুলোতে আমরা শিল্পায়ন থেকে শুরু করে যা করার করতে হবে পরিকল্পিতভাবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫ ভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি থেকে জাতীয় আয়ের ৬০ ভাগ অর্জিত হয়। কৃষি ও কৃষকের সমৃদ্ধির ওপরই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করে। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি আশি লাখ বসতবাড়ি রয়েছে। এসব বাড়ির মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন কৃষি। গ্রামের গৃহস্থের বাড়িগুলোতে পরিকল্পিতভাবে শাকসবজি, ফল, ঔষধি গাছসহ বৃক্ষরোপণ করে ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের উৎস হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে পরিবারের পুষ্টির প্রাপ্যতা ও আয় বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশও উন্নত হবে।
বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বলছেন, জমির উৎপাদন শক্তি বা সঠিকভাবে 'ইউনিট' প্রতি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর নাও চলতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই জমির উৎপাদিকা শক্তি বা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। অনেক 'ইনপুট' দিয়ে প্রান্তিক বৃদ্ধি কিছুটা সম্ভব হলেও বড়সড় বৃদ্ধির সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। উপরন্তু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার যেমন 'জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ক্রপস' বা 'অ্যানিম্যাল ক্লোনিং' কোনোটাই বিতর্কের বাইরে নয়। দ্বিতীয় একটি সবুজ বিপ্লবের খুব প্রয়োজন থাকলে মাটি বা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে তা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বিজ্ঞানী মহলে। এই ভয়ংকর ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কৃষিজমি সংরক্ষণের কথা আমাদের ভাবতে হবে। আগামী দিনের সম্ভাব্য চাহিদা-জোগানোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজকের ভূমির ব্যবহারকে যদি একটু একটু করে সঙ্গতিপূর্ণ করে না তোলা যায়, তবে ভবিষ্যতে মানুষ না পাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য, না বাঁচবে পরিবেশ।
প্রধানত দু'ভাবে কৃষিজমি নষ্ট হতে পারে : ১. নানা কারণে জমির উৎপাদন শক্তি কমে গিয়ে বা জমির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মাটির গুণাগুণের সার্বিক অবনমনের মাধ্যমে তা ক্রমশ ফসল উৎপাদনের পক্ষে সহায়ক না হয়ে উঠতে পারে এবং ২. বসবাস, পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পায়ন প্রভৃতি কারণে ভূমির ব্যবহার বদলে গিয়ে কৃষিজমির চরিত্রও পাল্টে যেতে পারে। প্রথম প্রকারের ক্ষেত্রে মাটির যথাযথ পরীক্ষার পর বৈজ্ঞানিক প্রথায়, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে চাষ করা প্রয়োজন। মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বিষয়গুলো যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সে বিষয়েও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। দ্বিতীয় প্রকারের ক্ষেত্রেই সমস্যাটা খুব জটিল। কারণ, এক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে কৃষিজমি এবং এ জমি ব্যবহারের প্রত্যক্ষ সংঘাতটা অনিবার্য হয়ে উঠছে। যদিও অর্থনীতির প্রশ্নে 'কৃষি' এবং 'উন্নয়ন'-এর মধ্যে সে অর্থে কোনো বিরোধ নেই। কৃষি আসলে একটি বহুমুখী উন্নয়ন প্রক্রিয়া। কোথায় কী ধরনের কৃষি হবে, তা নির্ভর করবে সেই অঞ্চলে সেই সময়কার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মানুষের চাহিদা এবং পরিবেশের ওপর।
তাহলে সমাধানটা কোথায়? অবশ্যই জমির প্রকৃতি এবং জমির ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে 'ল্যান্ড ব্যাংক' তৈরি করা এবং উন্নয়নের 'ইস্যু'তে তা যথাযথভাবে কাজে লাগানো। অর্থাৎ উর্বর কৃষিজমিতে যথাসম্ভব হাত না দিয়ে বিকল্প জমিতে শিল্প এবং আনুষঙ্গিক উন্নয়নমূলক কাজ করা। এক্ষেত্রে সমীক্ষার ভিত্তিতে একটি মডেল তৈরির কথা ভাবা যেতে পারে। যেমন ২০১৮ সালে দেশে কত জনসংখ্যা ছিল এবং ২০২১ সালে তা কত হয়েছে? বৃদ্ধির হার কত? জনসংখ্যা বেড়েছে কিন্তু কী পদ্ধতি নিলে ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বর্ধিত চাহিদাকে সামাল দিতে পারবে? এই বিষয়গুলোই মডেলে রাখা প্রয়োজন। সঠিক তথ্য ও প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনে সঠিক পদক্ষেপের দিশা পাওয়াটাই এই ধরনের সমীক্ষাভিত্তিক মডেলের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তবে এগুলোর সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় যুক্ত না করলে আগামী দিনে সমাধানের রাস্তায় পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে। কৃষিজমিকে উন্নয়নের কাজে কৃপণের মতো ব্যবহার করলাম- এটাই কৃষিজমি সংরক্ষণের মূল কথা হতে পারে না। একদিকে, বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিজমিকে যেমন আরও বেশি মাত্রায় আধুনিক, বৈজ্ঞানিক কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে আনতে হবে, অন্যদিকে নানা কারণে অব্যবহূত অথচ কৃষিযোগ্য জমিগুলোকে প্রত্যক্ষ কৃষি বা স্থান বিশেষে কৃষি-বনায়নের কাজে ব্যবহার করতে হবে।
তবে শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়েও সচেতনতা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ ও প্রয়োজনের নিরিখে এই ধরনের কোনো উদ্যোগ ক্ষুদ্র হলেও তুচ্ছ নয়। আগামী দিনের খাদ্যে যাতে ঘাটতি দেখা না দেয় এবং মানুষ যাতে নির্মল, সবুজ পরিবেশে বাস করতে পারে, এ জন্য সার্বিক প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে মানুষ ও কৃষিজমির কাম্য অনুপাত রক্ষা করতেই হবে। বজায় রাখতে হবে সার্বিক উন্নয়নের ধারাও। কীভাবে এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা যায়, এর জন্য সর্বস্তরে মতবিনিময় ও আন্তরিক প্রয়াস জরুরি।
সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী
মন্তব্য করুন