বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত বাক্য সম্ভবত 'বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে।' ২০১৪-এর জাতীয় নির্বাচন বাদে বেশিরভাগ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি, আপ্রাণ চেষ্টা করেছে প্রচার-প্রচারণায় মাঠে থাকার কিন্তু প্রতিটি নির্বাচনের শেষে দেখা গেছে নির্বাচনটি শেষ হয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তার, নতুন মামলার আসামি হওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে। গত কয়েক বছরে প্রতিটি নির্বাচনেই কমবেশি যে বেশিষ্ট্যগুলো দেখা গেছে, সেগুলো হলো- ১. ভোটার উপস্থিতি খুবই কম; ২. প্রচার-প্রচারণা এবং নির্বাচনের দিন তুলনামূলকভাবে কম সহিংসতাপূর্ণ, সহিংসতা যতটা হয়েছে সেটাও হয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে; ৩. বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্রে কোনোভাবেই থাকতে না দেওয়া; ৪. বিএনপির ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রবিমুখ করা; ৫. ভোটারদের প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ৬. বিএনপির ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অন্ধ-বধিরের ভূমিকা, ৭. নতুন মামলা দিয়ে বা পেন্ডিং মামলায় বিএনপি কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার। সর্বোপরি অবিশ্বাস্য ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থীর পরাজয় এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় লাভ। অর্থাৎ একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের সব বৈশিষ্ট্য আছে সবগুলো নির্বাচনে।

এই দেশে সর্বশেষ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল সম্ভবত ২০১৩ সালে, যেখানে সবকয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জিতেছিল। সেই বিএনপি প্রার্থীরা এখন শুধু পরাজয় নয়, বহু ক্ষেত্রে জামানত হারিয়ে ফেলছে। এখন পর্যন্ত দুই ধাপে যে ৮৫টি পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে, তাতে ৪২ জন বিএনপি প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। বিএনপি ক্ষমতায় যায়নি এর মধ্যে, নতুন কোনো বিরোধী শক্তি অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, তাই রাতারাতি বিএনপির এতটা অজনপ্রিয় হওয়ার ব্যাখ্যা কী?

সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়ে গেল ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামে। এই নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন সচিব এবং একজন নির্বাচন কমিশনারের পাল্টাপাল্টি মন্তব্য বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এই নির্বাচনে নূ্যনতম কোনো অনিয়ম ইসি সচিবের চোখে পড়েনি, বরং অনিয়ম যদি কিছু হয়ে থাকে সে ব্যাপারে ইসি সচিব বলেন, 'বিএনপির অভিযোগের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। উপযুক্ত প্রমাণসহ অভিযোগ করা হলে বিষয়টা ভেবে দেখা হবে, ভিডিও থাকলে ভালো হয়।' অর্থাৎ বিএনপির দায়িত্ব হলো, অনিয়ম খুঁজে বের করে, ভিডিও ধারণ করে তার হাতে তুলে দেওয়া, যাতে তিনি কিছুটা ভাবার অবকাশ পান; ব্যবস্থা নেওয়া বহু দূরের কথা। বুঝে পাই না, সব যদি বিরোধী দল করে দেয়, তাহলে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের কাজ কী? তাদের পেছনে কোটি টাকা খরচ করার কারণটাই-বা কী?

অন্যদিকে কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মতে, চট্টগ্রামের নির্বাচন 'অনিয়মের' মডেল। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে 'ভোটার উপস্থিতি চায়নি আওয়ামী লীগ, ইসি ছিল দর্শকের ভূমিকায়' শিরোনামের রিপোর্টে বলা হয়, '২৭ জানুয়ারি ভোটের দিন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে ভোটার নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে অবস্থান করে কোথাও কোথাও ইভিএম মেশিনে চেপে নৌকায় ভোট নিশ্চিত করেছেন। কোথাও কোথাও ভোটারদের নৌকায় ভোট দিতে প্ররোচিত করেছেন।

কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, ভোটকেন্দ্রের এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে ভোটের যে স্বাভাবিক প্রবণতা (ট্রেন্ড), তা নষ্ট হয়েছে। ২২টি কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী শূন্য ভোট পেয়েছেন। এসব কেন্দ্রের ১৩টিতে মেয়ের পদে যত ভোট পড়েছে, তার সবই পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ভোটারের আকালের মধ্যেও ৯টি কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। আবার ১৩টি কেন্দ্রে ২ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। ১১৯টি ভোটকেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট পড়েছে এক থেকে পাঁচটি। আর ৬৫টি কেন্দ্রে ৬ থেকে ১০টি ভোট পেয়েছে বিএনপি।'

শুধু ভোট প্রাপ্তির হারই নয়, ভোট পড়ার গতিও নির্বাচনের ব্যাপারে খুব বড় প্রশ্ন তৈরি করে। ভোট শুরুর প্রথম চার ঘণ্টায় গড়ে ভোট পড়েছে মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ। কিন্তু পরের চার ঘণ্টায় ভোটের এ হার হঠাৎ করে বেড়ে যায় কয়েক গুণ।'

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪১টি সাধারণ কাউন্সিলর ও ১৪টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে বিএনপির কেউ জয়ী হননি। এমনকি ২০১৫ সালের নির্বাচনেও বিএনপির নয়জন প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনও অত্যন্ত খারাপ হয়েছিল, কিন্তু এর সঙ্গে এবারকার নির্বাচনকে তুলনা করলে দেখা যাবে, এই দেশে নির্বাচন ব্যবস্থাটি কতটা খারাপ অবস্থায় চলে গেছে।

২০১৫ সালের নির্বাচনে মাত্র তিন ঘণ্টা ভোটের মাঠে থেকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন ৩ লাখের বেশি। এবার সারাদিন মাঠে থেকেও বিএনপি প্রার্থী ভোট পেয়েছেন মাত্র ৫২ হাজার। আবার গতবারের বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে বিএনপি প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল এক লাখ ৭০ হাজার ৫২৪। কিন্তু এবারের বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে বিএনপি প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান তিন লাখের বেশি। গতবার মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট প্রদান করেছিলেন। এবার ভোটার সংখ্যা বাড়লেও ভোটদানের হার মাত্র ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। যদিও ইসি সচিবের মতে, ভোটের হার কম হওয়ার কারণ উন্নয়ন। আমার এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বন্ধু প্রশ্ন করলেন, ৫ বছরের ব্যবধানে 'উন্নয়ন' যদি ৪৭ থেকে ভোট নামিয়ে আনতে পারে ২২ শতাংশে, তাহলে আর ৫ বছর পর ভোটের অবস্থা কী দাঁড়াবে?

এই নির্বাচনের আরেক উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়া। দেশের সব বিরোধী দলের মতের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ে ইভিএম মেশিন কেনা হয়েছে। যুক্তি ছিল দুটি, এতে খুব দ্রুত ফল পাওয়া যাবে, আর এতে কারচুপি করা সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হতে সময় লেগেছে ১০ ঘণ্টারও বেশি। এই দেরি প্রসংগে রিটার্নিং কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলেন, 'নির্বাচন নিয়ে আমরা সফল। কিন্তু নির্ভুলভাবে ফল দিতে সময় লাগছে।' 'নির্ভুল' প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের হাসানুজ্জামান ব্যাখ্যা দেন এভাবে- 'ইভিএমে যে ফল পাওয়া যাচ্ছে, তা নির্ভুলভাবে দিতে আবারও ম্যানুয়ালি যোগ-বিয়োগ করে কম্পিউটারে দিচ্ছে। তাই সময় বেশি লাগছে। এ ছাড়া ভোট প্রদানের হার এবং কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের যে পরিস্থিতির কথা আগেই বলা হলো, তাতে এই নির্বাচন স্বচ্ছতার স্রেফ বিপরীত শব্দে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলগুলো ইভিএম নিয়ে যে অভিযোগ করে এসেছিল, সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিটি নির্বাচনে।

নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের কথা যদি সরিয়েও রাখি, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'দ্য ইলেক্টোরাল ইন্টিগ্রিটি প্রজেক্ট ২০১৯' যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেখানে নির্বাচনের মানের বিবেচনায় বাংলাদেশের স্কোর ৩৮, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। সারা পৃথিবীতেই বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ নির্বাচন হয় মাত্র ২১টি দেশে। এই স্টাডিতে বাংলাদেশের শুধু ২০১৪ সালের নির্বাচনকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচন বিবেচনায় নেওয়া হলে বাংলাদেশ সম্ভবত থাকতো বিশ্বের সর্বশেষ অবস্থানে।

সংসদ সদস্য; কলাম লেখক