বাংলা ভাষার যে বর্ণমালা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকে বাঙালির হৃদয়ে, হয় অনাবিল আলোর উৎস কিংবা দিকনির্দেশনা করে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনায়নে সেই বর্ণমালাকে যখন কবি দুঃখিনী বলে আখ্যায়িত করেন, তখন সম্ভবত সেই দুঃখের মাত্রাটি কেবল রাজনৈতিক বাদ-বিসম্বাদেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এই বর্ণমালার সমন্বয়ে যে শব্দ ও বাক্য আমরা উদয়াস্ত নির্মাণ করি, সেই নির্মিতিতেও থেকে যায় অনেকগুলো বিচ্যুতি। কবি শামসুর রাহমান যখন সেই বর্ণমালাকে নিয়ে 'খ্যাংরার নোংরামি' দেখেন, দেখেন 'খিস্তি খেউড়ের পোষ মাস' তখন আমরা দ্রুত সেই ঐতিহাসিক উপলব্ধিতে পৌঁছে যাই, যেখানে পাকিস্তানি শাসকের হাতে আমাদের ভাষা হয়েছে সেভাবে লাঞ্ছিত, যেভাবে হয়েছেন আমাদের বহু নারী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, নিঃসন্দেহেই বলা যায়, বাংলা ভাষার প্রসার ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। সেই সম্ভাবনার সবটুকু যে অর্জিত হয়েছে তা নয়, কিন্তু বাংলা ভাষার যে ব্যাপক ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি প্রায় এক-ভাষিক বাংলাদেশে, সেই সামাজিক ও রাজনৈতিক আনুকূল্যই আমাদের ভাষার বিস্তৃতিতে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য একটি নতুন গতি লাভ করেছে এবং নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা এ ক্ষেত্রে এগিয়েছি অনেকখানি। পরিভাষাগত সীমাবদ্ধতা আমরা কাটাতে চেয়েছি, স্বাধীনতার সেই প্রথম প্রহর থেকেই। হয়তো বাংলা ভাষার যে সামূহিক ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি ছিল আমাদের সত্তর দশকের গোড়ার দিকে, তার সবটুকু পূরণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু ভাষা ব্যবহারে আমাদের অর্জন ও নিতান্ত সামান্য নয়।

বিশ্বায়ন এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নিজেদের সংশ্নিষ্ট করার পেশাগত তাগিদের কারণেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষালাভ এখন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজি ভাষাকে এখন কেবল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলের ভাষা বলে প্রত্যাখ্যান করলে চলবে না, বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে, বিশ্বায়নের এই যুগে ইংরেজি ভাষা যে বাণিজ্যিক আধিপত্য লাভ করেছে বিশ্বব্যাপী, সে কারণেই মূলত এই ভাষার পঠন-পাঠন সম্পর্কে অ-ইংরেজিভাষী রাষ্ট্রগুলোতে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। চীন কিংবা জাপানের মতো যেসব দেশে ভাষা তাদের জাতীয় পরিচিতির একটি আবশ্যিক বাহন ছিল, সেখানেও পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। কাজেই সত্তরের দশকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের যে এক ধরনের উত্থান আমরা লক্ষ্য করি, এখনকার বিশ্ব তা থেকে অনেকখানি ভিন্ন। কিন্তু এই কঠিন বাস্তবতা সত্ত্বেও বাঙালিকে এ কথা ভুললে চলবে না যে, বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছে, তা হলো বাংলা ভাষার পক্ষে আমাদের নিরলস সংগ্রাম।

বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যে কোনো রকমের অবমূল্যায়ন, কেবল যে বায়ান্নর শহীদদের আত্মার অবমাননা হবে তাই-ই নয়, বরং যে ভিত্তি ও আদর্শের ওপর নির্মিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ একাত্তরে, সেই আদর্শের প্রতি করা হবে বিশ্বাসঘাতকতা এবং সে রকমটি হলে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের একেবারে মর্মমূলে আঘাত লাগবে। আমাদের সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাংলা ভাষার মর্যাদাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলা ভাষার এমন সার্বিক ব্যবহার দেখে পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুরা অনেককেই দেখেছি বিস্মিত হতে।

বাংলা ভাষার এই ব্যাপক ব্যবহারের কারণেই বোধ করি, প্রয়োগে শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার প্রশ্ন উঠছে জোরেশোরে। মুখের ভাষার উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে শব্দ নির্মাণ, বাক্যবিন্যাস- এসব নিয়েও বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। এ ধরনের বিতর্ক আমরা লক্ষ্য করেছি সব ভাষার বিবর্তন ও বিকাশের মূহূর্তে ঘটে থাকে, সনাতনপন্থিদের সঙ্গে সমসাময়িকপন্থিদের। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সনাতনপন্থিরা বরাবরই ব্যাকরণকে বাক্যের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্র হিসেবেই মনে করেন। অন্যদিকে, যারা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের সমর্থক তারা মনে করেন যে, ভাষায় ঔচিত্যের প্রশ্নের চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সমসাময়িক সময়ে ভাষা যেভাবে ব্যবহূত হচ্ছে তার বর্ণনা এবং সেই বর্ণনার ভিত্তিতে গঠিত সূত্র। এই দু-ধরনের মেরুবর্তী মতবাদ যারা পোষণ করেন, তাদের মধ্যে বৌদ্ধিক বিতর্ক বহু পুরোনো। ভাষার যে নিজস্ব স্বতঃস্ম্ফূর্ত ধারা বয়ে যায় অনেকটা নদীর মতোই, সেই প্রবাহই ভাষাকে করে তোলে জীবন্ত, ভাষায় আনে সৃজনশীলতা। সেখানে যে কোনো রকমের নিয়মের দেয়াল ভাষার নিজস্ব গতিকে করে খর্ব, ভাষা হয়ে পড়তে পারে ব্যাকরণিক সূত্রে আবদ্ধ কোনো বিষয়। এটি বোধ করি কোনো জীবন্ত ভাষার অস্তিত্বের জন্য কাম্য হতে পারে না। ভাষায় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিবর্তন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। কিন্তু এই স্বতঃস্ম্ফূর্ততা মেনে নেওয়ার পরও ভাষাকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার প্রয়োজন রয়েছে সর্বসাধারণের জন্য। দুর্ভাগ্যবশত বাংলা ভাষা এখন এতটাই মুক্তবিহঙ্গ যে, ভয় হয় সে কী এখন ভিন্ন মেরুর, 'খ্যাংরার নোংরামি'!

জানি অনেকেই হয়তো বলবেন যে, কবি-সাহিত্যিকরা তো ভাষার নিয়ম তেমনভাবে রক্ষা করেন না। জীবনানন্দ তো রীতিমতো তার একটি কবিতার নামই করলেন, 'আশ্চর্য বিস্ময়'। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষে এই নিয়ম লঙ্ঘন আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে। জীবনানন্দের আশ্চর্য বিস্ময় নামকরণের পেছনে যে শাব্দিক ব্যঞ্জনা রয়েছে তা তো কেবল কবিকেই শোভা পায়। তাই বলে আমরা যদি বলি, যেমনটি অনেকেই আজকাল বলেন, 'করোনাকালীন সময়' তাতে ব্যঞ্জনা নয়, গঞ্জনা পাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ভাষাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করেও বলতে পারি যে, বহতা নদীকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তা হলে সেই নদী দু'কূল প্লাবিত করে ফেলতে পারে। ভাষাও যদি নিয়মের নিগড় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পড়ে, তা হলে প্রতিটি মানুষের ভাষা হয়ে উঠবে ভিন্ন এবং কয়েক শতকের মধ্যেই পরস্পর দুর্বোধ্য। সে জন্যই বোধ করি ভাষাতত্ত্বের এই দুই প্রান্তবর্তী মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, ভাষার উন্নতিকে নিশ্চিত করা যায়।

বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে ত্রুটি-বিচ্যুতি আমরা লক্ষ্য করি, তার সবটাই অজ্ঞতা প্রসূত নয়, বরং ইংরেজি থেকে অনুবাদের কারণেও কিছু কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য ভুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে যাকে ভাষাতাত্ত্বিকরা 'মাদার টাঙ ইন্টারফেয়ারেন্স' বলে থাকেন এবং সেই মাতৃভাষার কারণে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে যেমন ছাত্রছাত্রীরা ভুল করে থাকেন, বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বলা যায় এক ধরনের 'ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারফেয়ারেন্স' বা বিদেশি ভাষার প্রভাব আমরা ইদানীং লক্ষ্য করি। যেমন ধরুন, ঢাকা ও কলকাতার সংবাদপত্রের শিরোনামে এবং ইদানীং সংবাদের ভেতরেও আমরা দেখি সংখ্যাবাচক শব্দের প্রয়োগে যে সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা যে কেবল ব্যাকরণসম্মত নয় তা-ই নয়, তা শ্রুতিগ্রাহ্যও নয়। যেমন ধরুন, চার ডাকাত খুন, পাঁচ পুলিশ আহত। বাংলা ভাষায় সংখ্যাবাচক বিশেষণ ব্যবহারের একেবারে মূল নিয়মটিই এই সরলায়নে বিনষ্ট হচ্ছে।

ইংরেজিতে সংখ্যাবাচক বিশেষণের পর আর কিছু লেখার দরকার নেই, সংশ্নিষ্ট বিশেষ্য ছাড়া। কিন্তু বাংলায় এই সংখ্যাবাচক বিশেষণের পর, পরিমাপের একক ব্যবহার করতে হয়, অথবা টা, টি, গুলো, গুলি এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে হয়। বাংলা ভাষায় 'জন' শব্দটির দুটি অর্থ। একটি অর্থে জন হচ্ছে মানুষ আর অন্য অর্থে আবার এই জন হচ্ছে মানুষ পরিমাপের একক। সে জন্যই তিনজন, চারজন ব্যবহূত হয় এবং সেই কারণেই চারজন লোক কথাটি ভুল নয়, কারণ এখানে 'জন'-এর অর্থ লোক নয়, এটি লোক পরিমাপের গণনার একক। সংখ্যাবাচক বিশেষণের সঙ্গে অতএব, পরিমাপের একক ব্যবহার না করলে সেটি শুদ্ধ বলে ধরে নেওয়া যায় না। আজকাল অবশ্য বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রে এই নিয়মটির ব্যত্যয় ঘটছে।

ভাষাকে সরল করার উদ্দেশ্যে এই পরিবর্তন আনা হচ্ছে নাকি এই প্রভাব ও অনূদিত সংস্কৃতির অংশ সেটি বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। এই সংখ্যা সম্পর্কিত আরও একটি ভ্রান্ত প্রয়োগ আমরা ইদানীং লক্ষ্য করছি, তারিখ লেখার সময়ে। আগে যেভাবে তেসরা, দোসরা, ৫ই, ২৭শে এ ধরনের ব্যবহার ছিল প্রচলিত এবং বিশুদ্ধও বটে। এখন তার বদলে দেখি ২ জানুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ। সংবাদপত্রে ছাপার সময়ে স্থান সংকুলানের জন্য ছাপার অক্ষরে সংখ্যা নির্ণয়ক শব্দে এ ধরনের প্রয়োগ ভুল নয়, বিশেষত স্থান সংকুলানের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে সংবাদপত্রের শিরোনামে এ রকম লেখাই যেতে পারে। কিন্তু বেতার-টেলিভিশনের সংবাদ পাঠক-পাঠিকারা যখন পাঠ করেন সংক্ষিপ্তভাবে, তখন সেটি সিদ্ধ প্রয়োগ নয় আদৌ। সন্দেহ নেই যে, এই রূপান্তরণ ঘটেছে ইংরেজিতে তারিখ লেখার সনাতন নিয়মের বিবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু বাংলায় তারিখ লেখার নিয়মের এই অতি সরলীকরণের কারণে সংখ্যার পাশে শব্দ প্রয়োগের যে নিয়ম ছিল, তাকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে সজ্ঞানেই। বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি বেতার, টেলিভিশনে এ ধরনের প্রয়োগ খুব বেশি শ্রুতিকটু হয়ে উঠছে।

অনূদিত সংস্কৃতির প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি বাংলা ভাষার আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে। বেশ কয়েক বছর ধরে টেলিফোন করা অর্থে ফোন দেওয়া কথাটি প্রচলিত হয়ে উঠছে দ্রুত। গোড়াতে এই ফোন দেওয়ার কথা আমার এক বন্ধু এক সময়ে বলায়, তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, তার আগামী জন্মদিনে তাকে দোকান থেকে একটি ফোন কিনে দেব। আমার এই ঠাট্টার বিষয়টি বুঝতে তার সময় লেগেছিল। কিন্তু এখন এ নিয়ে ঠাট্টা করলে লোকজন আমার ভাষাজ্ঞান সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে পারে।

ইংরেজি ভাষার মতো বাংলা ভাষা প্রচুর ক্রিয়াপদে সমৃদ্ধ নয়। কিন্তু বাংলা ভাষার মস্ত বড় সুবিধাটা হচ্ছে, 'করা' ক্রিয়াপদটি যা যে কোনো বিশেষণকে সহজেই বিশেষ্যে পরিণত করতে পারে, যেমন- গান করা, রান্না করা, সেলাই করা, চাকরি করা, পড়াশোনা করা- এ রকম প্রচুর দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় যেখানে এই ক্রিয়াপদটি ভাষাকে করেছে সহজ।

ক্রিয়াপদটির একটি ভ্রান্ত ব্যবহার ও সম্প্রতি লক্ষ্য করেছি পশ্চিমবঙ্গের একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গানের প্রতিযোগিতায়। প্রতিযোগীরা যেখানে ফোন করে তাদের ভোট দেওয়ার কথা বলছেন, সেখানে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রচলিত ও শুদ্ধ ব্যবহার- আমাকে ভোট দিন-এর পরিবর্তে, আমাকে ভোট করুন বলছেন। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি ছিল ফোন করে, ভোট দিন। কিন্তু সংক্ষেপে এখন বলা হচ্ছে 'ভোট করুন'। এই বাক্যাংশটি কোন উর্বর মস্তিস্কের ফল, সেটি বলা মুশকিল।

এসব অপপ্রয়োগের পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রমিত উচ্চারণের ক্ষেত্রেও একটা বড় রকমের ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশের, বিশেষত ঢাকাকেন্দ্রিক শহুরে সমাজে। রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের বাস এবং বাংলাদেশ মূলত এক ভাষিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এর আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য ব্যাপক ও বহুমুখী। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই অতি সামান্য আয়তনেও আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য অসামান্য। এই বৈচিত্র্য আমাদের ভাষাকে সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে এবং এই বৈচিত্র্যকে আমাদের সংরক্ষণ করতেই হবে। কিন্তু এই আঞ্চলিক ভাষার বিশৃঙ্খল মিশ্রণ, আমাদের প্রতিদিনকার প্রমিত বাংলা উচ্চারণে যে প্রায় এক ধরনের দুঃসহনীয় মিশ্র ধ্বনি সৃষ্টি করেছে, সেটি লক্ষ্য করার বিষয়। একদিকে বাংলার সঙ্গে ইংরেজির এবং অন্যদিকে আঞ্চলিক ভাষার এই মেরুবর্তী মিশ্রণ ভাষার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করছে। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকে শহুরে কেতাদুরস্ত ছেলেমেয়েদের সংলাপ বিস্ময়করভাবে একটি পৃথক রূপ নিচ্ছে। লক্ষ্য করা গেছে, যেসব তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়ের বাবা-মা প্রমিত বাংলা উচ্চারণে অভ্যস্ত, তারাও এক ধরনের মিশ্র আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করছে। অজ্ঞতাবশত নয় ততটা, যতটা শৌখিনতার বশবর্তী হয়ে।

ইংরেজিতে বলে 'পিয়ার প্রেশার'। সহপাঠী, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সম্ভবত এক ধরনের ভাষিক সাযুজ্য প্রকাশের তাড়নায় ভাষায় আসছে এ ধরনের মিশ্রণ যা আমরা লক্ষ্য করি নাটকের মতো একটি শিল্প মাধ্যমেও। নাটক যে কেবল জীবনের প্রতিবিম্ব হতে পারে তাই নয়, এ ধরনের অত্যন্ত শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের একটা বড় দায়িত্ব হচ্ছে ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করা। ভাষা নদীর জলপ্রবাহের মতোই স্বতঃস্ম্ফূর্ত গতিতে এগিয়ে যাবে এই যুক্তিতে ভাষার শৃঙ্খলাকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা নেই, এরকম মন্তব্য যারা করেন, তারা ভুলে যান যে, নদীর বিশৃঙ্খল বিস্তৃতিকেও রুদ্ধ করতে হয় মানুষ ও প্রকৃতির কল্যাণেই। ভাষার বিকাশ আমাদের অবশ্যই কাম্য এবং আঞ্চলিক ভাষা কিংবা বিদেশি ভাষার প্রয়োগ আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল করতে পারে নিঃসন্দেহেই। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে অনুপাতের।

অবিমিশ্র বাংলা প্রয়োগ করতে গিয়ে যেমন টেলিফোনের পরিবর্তে দূরালাপনী কিংবা ইন্টারনেটের বাংলা অন্তর্জাল শব্দটি ব্যবহারের প্রয়োজন নেই, তেমনি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বাক্য কাঠামো এবং শব্দবন্ধের সবকিছু ভেঙে ফেলার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটি ভাষার সুশীল ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলও তাদের সাহিত্যে ব্যাকরণের বেড়াজাল ডিঙিয়েছেন সৃজনশীল প্রতিভার শক্তিতে, কবি শামসুর রাহমান কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের মতো সব্যসাচী লেখকরাও প্রচুর আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করেছেন তাদের কাব্যে। কিন্তু এসবই করেছেন বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য।

শামসুর রাহমানের 'বেবাক' শব্দের জুৎসই ব্যবহার কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের, 'মানুষ আসতাছে বানের লাহান', আমাদের সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। আমরা লক্ষ্য করেছি, আমাদের নিতান্ত আটপৌরে আঞ্চলিক শব্দগুলো কতখানি শক্তিশালী হতে পারে, সাহিত্যের ভাব প্রকাশের জন্য। কিন্তু অপ্রয়োজনে এ রকম আঞ্চলিক বা ভুল ইংরেজি শব্দের প্রাত্যহিক প্রয়োগ ভাষার মূল কাঠামোকে দুর্বল করে তোলে এবং মাঝেমধ্যে আশঙ্কা হয়, এ ধরনের মিশ্র শব্দ প্রয়োগে অভ্যস্ত তারুণ্যশক্তি হয়তো কালক্রমে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান এমনকি হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়তেও আগ্রহী হবে না। বঙ্কিম কিংবা মীর মশাররফ হোসেনের কথা না হয় বাদই দিলাম।

এই অনভ্যাস, এই অপপ্রয়োগ এই ভুল অনুশীলন আমাদের। নিজেদেরই তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে যাবে আমাদের থেকেই অনেক দূরে। আমাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আরবি কিংবা রোমান হরফে বাংলা লেখার যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে, আমরা তা প্রতিহত করেছিলাম রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে যেমন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতার মাধ্যমেও। আজ আমাদের নিজেদের তারুণ্যশক্তি ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে, নিজের অজান্তেই সেটি কি আমাদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, 'আজি হতে শতবর্ষ পরে'- তাই আমাদের ভাবনা, বাংলা ভাষা কি থাকবে বাংলা ভাষাতেই? নাকি ভাষা অপহৃত হয়ে গিয়ে এর সমস্ত অপভ্রংশ নিয়েই তৈরি হবে এক নতুন ভাষা!

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক