ছোটবেলায় শুনেছিলাম সব পরিকল্পনারই থাকে একটি সৎ উদ্দেশ্য। তবে পরিকল্পনামাফিক কাজের অভাবে অনেক সময় পরিকল্পনার 'পরি' আকাশে উড়ে যায় আর 'কল্পনা' ধুলোয় লুটোপুটি খায়।

আমাদের অর্থনীতি ক্লাসের পরিকল্পনা বিষয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক প্রায় প্রথমদিকেই বলেছিলেন, রাষ্ট্রের সম্মুখদর্শী জাতীয় অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও উন্নয়ন রূপকল্পের গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত দলিল পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। অনেক দেশেই এ ধরনের পরিকল্পনার প্রচলন রয়েছে। চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, আর্জেন্টিনা, রোমানিয়াসহ অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্দিষ্ট সময় অন্তর এ পরিকল্পনা প্রণীত হয়। পূর্বে একবার দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হলেও এখন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাই আমাদের স্ট্যান্ডার্ড।

অর্থনীতিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে সাধারণত দেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যগুলো, সংস্কার উদ্যোগ এবং তার বাস্তবায়ন কৌশল প্রকাশ পায়। সেই বিবেচনায় অর্থনীতির ধারাবাহিক অগ্রগতিতে একটি সময়োপযোগী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের তাৎপর্য বিরাট। ২০২০ সালের জুনে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়নকাল শেষে জুলাই থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারির কারণে নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি চূড়ান্তকরণ বিলম্বিত হয়েছে। কিছুটা সময় পেরিয়ে অবশেষে বছর শেষে এটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে।

এই পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সরকারের নীতি-ধারাবাহিকতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নতুন পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) লক্ষ্যগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে গড় জিডিপি আট শতাংশে উন্নীতের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত, আয়বৈষম্য হ্রাস, সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা, টেকসই নগরায়ণ, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রবর্তনে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি ও শিক্ষার গুণগত মানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু এগুলো কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, তার সুস্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত কর্মপন্থার রূপরেখা পরিস্কার হয়নি। বৈদেশিক অর্থায়ন-নির্ভরতার বিপরীতে এবার নিজস্ব অর্থায়নে জোর দেওয়া হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশের ওপর বেসরকারি খাত থেকে সংস্থানের কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের এ সময় পর্বে অর্থায়ন প্রশ্নে জাতীয় সক্ষমতার প্রতিফলন ঘটানো অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে সেটি কতটা বাস্তবে সম্ভব হবে, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়। কেননা পিপিপিভিত্তিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। কয়েক বছর আগে থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে পিপিপি ধারণা চালু হলেও এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাত খুব একটা এগিয়ে আসছে না। অনেকে যদিও দেশের ব্যক্তি খাতকে এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারি অনুকম্পা নির্ভরশীল বলেন, তবে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এখনও লাভজনক ক্ষেত্র বিবেচিত না হওয়ায় পিপিপি বিষয়ে বেসরকারি খাতের এ অনাগ্রহ বলে অনেকের ধারণা। ফলে কিছু প্রকল্প অর্থায়নজনিত অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাস্থ্য সংকটের কারণে এখন বেসরকারি খাতে আর্থিক ও ব্যবসায়িক মন্দা চলছে। এ অবস্থায় নতুন পরিকল্পনায় পিপিপির মাধ্যমে যে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন আরও কঠিন হবে বলে সহজেই অনুমেয়।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিক থেকে বর্তমান সময়টি আমাদের জন্য ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ হলেও কভিডসৃষ্ট নানামাত্রিক অভিঘাতের কারণে এটি বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার সময়ও। প্রতিটি দেশই চলমান অতিমারিতে জনস্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় এখন তাই সব দেশই কভিড-১৯ মোকাবিলা এবং পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রাধিকার দিচ্ছে। চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও অনুরূপভাবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুণগত উল্লল্ফম্ফনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এ জন্য লক্ষ্যাভিমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছুদিন আগে অনুমোদিত ২০২১-২৫ সালের নিজস্ব পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চীন নভেল করোনাভাইরাস অতিমারি থেকে উত্তরণকে প্রাধান্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথরেখা দাঁড় করিয়েছে। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন আপাতত বন্ধ রাখলেও অন্য নীতি-পরিকল্পনায় কভিড উত্তরণের নীতি-কৌশল নিয়েছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং আমাদের প্রতিযোগী পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নিজস্ব নীতি-পরিকল্পনায়ও কভিড উত্তরণের বাস্তবসম্মত রূপরেখা দৃশ্যমান। তাই সংগত কারণেই নতুন পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়নে উল্লিখিত দেশের নীতি-কৌশল সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাগুলো আমলে নেওয়া যেতে পারে।

আমরা বেশিরভাগই জানি, এ দেশে বাস্তবায়ন একটি বড় সমস্যা। শুরুতে নীতি-পরিকল্পনায় সুন্দর কথামালা লিপিবদ্ধ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো অবাস্তবায়িত থেকে যায়। ২০২০ সালের জুনে সমাপ্ত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। আলোচ্য পরিকল্পনাটি এমন এক সুস্থির সময়ে প্রণীত হয়েছিল, যখন দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত-গোলযোগ ছিল না বললেই চলে। খুব একটা সমস্যা ছিল না অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন ও অর্থায়নের ক্ষেত্রেও। অথচ সুশাসন, সমন্বয়হীনতা, সহায়ক বিনিয়োগ পরিবেশসহ বিভিন্ন কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর মতো পরিকল্পনার বড় লক্ষ্যগুলো অর্জন করা যায়নি। তাই পরিকল্পনায় সুলিখিত নীতির বিন্যাস থাকলে হবে না, তার বাস্তবায়নও নিশ্চিত করা চাই। একটি সংকটজনক পরিস্থিতিতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদ শুরু হওয়ায় তার বাস্তবায়নের বিষয়টি আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছে। অতিমারির কারণে অর্থনীতির অন্তর্নিহিত নাজুকতাগুলো পরিস্টম্ফুটিত হয়েছে। একই কারণে সম্পদ সঞ্চালনের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অষ্টম পরিকল্পনার বাস্তবায়নে নৈপুণ্য বাড়াতে হলে মূল বাধা বা চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর উদ্যোগ ও কৌশল নিতে হবে। বাড়াতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং জোরদার করতে হবে জবাবদিহি, পরিবীক্ষণ ও তদারকি।

দ্রুত প্রযুক্তিগত রূপান্তরের কারণে 'নতুন স্বাভাবিক' বা 'নিউ নরমাল'-এর আওতায় সমাজ, অর্থনীতি এমনকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও এ ধরনের কিছু সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে সেগুলো কার্যকর করা হয়নি এবং অনেকে বলেছেন, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে সম্ভব হয়নি। আলোচ্য পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো অপূরণীয় থাকার পেছনে এটিও একটি কারণ। কাজেই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর-সহায়ক সংস্কার কার্যক্রমও বেগবান করতে হবে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে নজরদারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সুশাসন, তাহলেই কেবল উন্নয়ন অর্থবহ এবং অংশগ্রহণমূলক হবে।

অর্থনীতি বিশ্নেষক