
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, (১৯৩৪-২০০১)
পঞ্চশের দশকে একুশের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলা সাহিত্যে একঝাঁক তারুণ্যদীপ্ত কবির অভিষেক ঘটে, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাদের অন্যতম। সরকারের সচিব, মন্ত্রী, উপদেষ্টার পরিচয় ছাপিয়ে একজন কবি হিসেবেই তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জীবনে যা কিছু করেছেন, শেষ পর্যন্ত কাব্যচর্চাই তার অনিবার্য গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করার পর সেখানেই অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে পিএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হয়ে তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং পরবর্তী সময়ে সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলা কাব্যচর্চার ধারাবাহিকতায় তৃতীয় প্রজন্মের কবি হিসেবে বিবেচিত। এই প্রজন্মের তরুণ কবিরা পাকিস্তানি ভাবধারা উপেক্ষা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা, আধুনিক শিক্ষা ও সাহিত্যের আলোয় উদ্ভাসিত। তাদের স্বদেশপ্রেম, নতুন কাব্যভাবনা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা কাব্যচর্চায়, চলমান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সর্বপ্লাবী জোয়ারের সৃষ্টি করে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাত নরী হার' প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর ও সাম্প্রদায়িক সাহিত্যচর্চার বৃত্তের বাইরে এসে এটি বাংলার লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম ঐতিহ্যকে চিহ্নিত ও চিত্রিত করেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের অতুলনীয় ভূমিকা ও আত্মদান তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। সে আবেগ ও বেদনারই ভিন্নতর ব্যঞ্জনার স্ম্ফুরণ ঘটে 'কোন এক মাকে' লেখা বিখ্যাত কবিতায়। বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের নিয়ে লেখা তার 'কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা' কবিতাটিতে কোটি বাঙালির প্রাণের কথাই যেন উচ্চারিত হয়েছে।
দীর্ঘ বিরতির পর তিনি লিখলেন 'কখনো রঙ কখনো সুর' (১৯৭০), 'কমলের চোখ' (১৯৭৪)। ইতোমধ্যে বাঙালির জীবনে ঘটে গেছে বহু উত্থান-পতন, একটি রক্তাক্ত সশস্ত্র সংগ্রামের পর বাঙালি অর্জন করেছে মহান স্বাধীনতা। এই সময়েও তার অন্তর্জগতে সক্রিয় দ্রোহ ও নির্মাণের কাব্যকলা। যা বিস্ম্ফোরিত হয় ১৯৮১ সালে 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি' নামে। স্বজাতির ইতিহাসকে ধারণ করা এহেন মন্ত্রসম উচ্চারণ বাংলা কবিতায় বিরলই বলা চলে। তার 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা' সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। এই সময়ে তিনি স্বনির্মিত ছড়ার বৃত্ত ভেঙে ঢুকে গেলেন নিপাট গদ্যের কাব্যভুবনে।
লোকজ ধারায় নিজেকে প্রকাশ করলেও তার কবিতায় আধুনিকতা বা আধুনিক আঙ্গিকের ঘাটতি ছিল না। দর্শন, আঙ্গিক, চেতনার দিক থেকে তিনি অগ্রজ কবিদের অনেকের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখানেই তার প্রতিভার মৌলিকত্ব। তার সর্বাধিক নন্দিত কাব্যগ্রন্থ 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি' কাব্যের ভেতর দিয়ে তিনি ঋজুভঙ্গিতে যে সহজসরল স্বীকারোক্তি করেছেন, তাতে সমকালীন কবি ও সাহিত্যামোদীরা বিস্মিত হয়েছিলেন। অনেক পাঠক দীর্ঘদিন পর যেন কোনো মহান মুক্তিদাতার কণ্ঠস্বর শুনতে পেরেছেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর গ্রন্থসংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু তার সৃজিত কাব্যভুবন বাংলা সাহিত্যে এক অনবদ্য সংযোজন। দেশ, কাল ও ঐতিহ্যে তার কবিতা মানুষের সংকট, সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। আপসহীন কঠিন সময়ে তিনি সহজাত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছেন চরম বাস্তবতার কথা। কবিতার প্রতি, মা ও মাতৃভূমির প্রতি কত নিগূঢ় ভালোবাসা থাকলে এহেন জীবন্ত, সাহসী, অবিনাশী বক্তব্য উপস্থাপন করা যায় তা-ই আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার ছত্রে ছত্রে চিত্রিত।
কাব্যের আঙ্গিক গঠন, শব্দ যোজনার নৈপুণ্য কৌশল তার কবিতার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করে। শব্দের সাবলীল সাজে তিনি তৈরি করেছেন এক নিজস্ব ঢং। প্রকৃতির রূপ ও রঙের বিচিত্রিত ছবিগুলো তার কাব্যকে করে তুলেছে রূপসী বাংলার অনন্য প্রতিচিত্র। তার কবিতা যেন অথৈ সাগরে যুদ্ধবিধ্বস্ত নাবিকের কাছে নির্ভরতার পাটাতন। যে পাটাতনে জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের আহ্বান সগর্বে প্রতিধ্বনিত হয় দ্রোহী কাব্যঝঙ্কারে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ৮৬তম জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
শিক্ষক
manoar.jnu.hosain@gmail.com
মন্তব্য করুন