
যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্পন্সর/ডাইরেক্টর কোম্পানির উন্নতির দিকে নজর না দিয়ে, ম্যানেজমেন্টকে শক্তিশালী না করে, হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ও শেয়ারহোল্ডারের স্বার্থ না দেখে শুধু নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য যখন শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করেছেন, তখন ২%, ৩০% শেয়ার হোল্ড করার বাধ্যবাধকতা না মেনে উচ্চদামে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। বাজারের সুযোগ নিয়ে যারা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখেছেন, সেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানি যেগুলো এখন জেড গ্রুপে আছে, শেয়ারের দাম ১০ টাকার নিচে, লাখো বিনিয়োগকারী তাদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে, সেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাকে সাধুবাদ জানাই। এটা একটি বাস্তব এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এই পদক্ষেপ সঠিকভাবে কার্যকর করা গেলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। একই সঙ্গে সব তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং তথাকথিত স্পন্সর/ডাইরেক্টরদের এই বার্তা দেবে যে, এখন থেকে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন না। সবাইকে পুঁজিবাজারে ১০০% কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে হবে। পুঁজিবাজারে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে লাভ নেই। তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সবাই শেয়ারহোল্ডার, কেউ মালিক নন। কেউ বড় শেয়ারহোল্ডার, কেউ ছোট শেয়ারহোল্ডার।
বিএসইসির প্রধানের দায়িত্ব হচ্ছে ছোট শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ১০০% সুরক্ষা করা। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বে বিএসইসি এই কাজ দৃঢ়ভাবে করে যাচ্ছে। পুঁজিবাজার ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরে আসছে। যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্পন্সর/ডাইরেক্টর কোম্পানির পারফরম্যান্সের দিকে নজর না দিয়ে, বিগত বছরগুলোতে ২%, ৩০% হারে শেয়ার হোল্ড না করে, শুধু নিজেদের স্বার্থে কৃত্রিমভাবে ভুল তথ্য দিয়ে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে বেশি দামে নিজেদের সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন, যাদের কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ টাকার নিচে, তাদের বাধ্য করতে হবে শেয়ারবাজার থেকে অন্তত অভিহিত মূল্যে শেয়ার বাই ব্যাক করার জন্য। যদি এটি না করেন তাহলে তাদের ম্যানেজমেন্ট পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। যদি কোনো বিনিয়োগকারী বাজার থেকে ২% শেয়ার ক্রয় করে থাকেন, তাহলে অটোমেটিক্যালি তাকে পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট পরিচালনার সুযোগ করে দিতে হবে। যদি সেই রকম কোনো সুযোগ না থাকে তবে এসব কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যার দায়িত্ব হবে কোম্পানির সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দক্ষ ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করা।
একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তথাকথিত স্পন্সর/ডাইরেক্টর, যাদের সম্মিলিত ৩০% শেয়ার নেই, তারা নিজেদের প্রভাব কোম্পানিতে বজায় রাখার চেষ্টা করছেন, যা একান্তই কাম্য নয়। তারা বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণা করছেন। এসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির তথাকথিত ডাইরেক্টরদের ব্যাপারে বিএসইসিকে কঠোর হতে হবে। বোর্ড পুনর্গঠনের দায়িত্ব বিএসইসির, এ ব্যাপারে কারও কোনো প্রভাবই খাটবে না। যারা বাজার থেকে শেয়ার কিনে বোর্ডে আসবেন, তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি থাকবে। একমাত্র তারাই পারবেন কোম্পানিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে। আমি মনে করি, বিএসইসি এই বোর্ড পুনর্গঠনে কোনো সমঝোতা করবে না, কারও দ্বারা প্রভাবিত হবে না, কারও কোনো আপত্তিও শুনবে না।
আমরা প্রায় প্রতিদিনই শুনতে পাচ্ছি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কত লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। যার পুরোটাই ডিপোজিটরদের টাকা। যার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তথাকথিত সব স্পন্সর/ডাইরেক্টর এবং ম্যানেজমেন্ট। আমি বারবার বলছি, ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে বেরিয়ে আসতে হবে। সবাই শেয়ারহোল্ডার, ব্যাংক চলে ডিপোজিটরদের টাকায়, কোনো তথাকথিত পরিচালকদের টাকায় নয়। ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসিকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। ব্যাংকের টাকা যারা লুটপাট করেছেন, পরিচালক হোন বা ম্যানেজমেন্টের লোক হোন, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। দেউলিয়া আইন সংশোধন করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে। এটাই টাকা আদায়ের বাস্তবসম্মত একমাত্র পথ।
যেসব ঋণখেলাপি সরকারি খাসজমি, ডোবা-নালা, হাওর মর্টগেজ দেখিয়ে অসৎ পথে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জনগণের ডিপোজিটের টাকা আত্মসাৎ করেছে, তাদের বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সুযোগ এসেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) হাতে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ও কঠোর অবস্থানের কারণে সবকিছু জিরো টলারেন্সে আছে। কোনো ধরনের অনিয়ম এবং দুর্নীতির ছাড় তিনি দেবেন না। সব দুর্নীতিবাজকে পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় নিয়ে আসা শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী পার্লামেন্টে প্রায় তিন লাখ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও তাদের কোম্পানির নাম প্রকাশ করেছেন। সবাই সোচ্চার হয়েছেন। নন-পারফরম্যান্স শেয়ার, জেড গ্রুপের শেয়ার, যেসব কোম্পানিতে তথাকথিত স্পন্সর/ডাইরেক্টরদের একক ও সম্মিলিতভাবে ২%, ৩০% শেয়ার নেই, তাদের পুনর্গঠনে বিএসইসি কঠোর এবং বাস্তব অবস্থানে থাকবে এটাই আমার এবং লাখো বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড।
মন্তব্য করুন