বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। সংশপ্তকের মতো লড়ে যাওয়া পুলিশ বাহিনীই রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সর্বপ্রথম পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তা ছাড়া জাতিসংঘ মিশনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা; ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, করোনার মতো মহামারিতেও বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
এত অবদান সত্ত্বেও কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনৈতিক, অসদাচরণ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ইমেজকে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে, যা সত্যিই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। পুলিশ যেখানে জনবান্ধব হওয়ার কথা, সেখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেন মূর্তিমান আতঙ্ক। আইনের রক্ষক না হয়ে পুলিশ যখন ভক্ষক হয়, তখন সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সাধারণ মানুষ তো দূরের ব্যাপার, খোদ প্রশাসনের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত অসদাচরণের শিকার হন পুলিশ সুপারের হাতে, যাকে সম্প্রতি হাইকোর্ট সতর্ক করেছেন। কাশিমপুর কারাগারের নারী কেলেঙ্কারির কথা তো সবারই জানা। জেলার, ডেপুটি জেলার, সার্জন, ইন্সট্রাক্টর ও কারারক্ষীরা ঘুষ নিয়ে কারাবন্দিকে নারীসঙ্গ উপভোগের সুযোগ করে দেয়।
পুলিশের অন্যতম কাজ সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সেখানে পুলিশ সদস্য চট্টগ্রামে অস্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়; নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার থানার দুই এসআই সরকারি অস্ত্র, পিস্তল, হ্যান্ডকাফ ব্যবহার করে দীর্ঘদিন সংঘবদ্ধ ডাকাতি-ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব দেন, যা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। বিপথগামী পুলিশ সদস্যের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জাতির জন্য অশুভ লক্ষণ। মাদকাসক্ত হওয়া, মাদক কারবারে সহায়তা, আবাসিক হোটেলে জুয়া খেলাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুলিশ সদস্য অনেকেই জড়িত। সম্প্রতি ডিএমপিতে সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যের ডোপ টেস্ট করা হয়। এ টেস্টে ধরা পড়ে অনেকেই চাকরি হারায়। যাত্রাবাড়ী থানার এক এসআই গভীর রাতে ব্যবসায়ীর বাসায় হানা দিয়ে টাকা লুট এবং তার অনুপস্থিতিতে স্ত্রীকে পাঁচ লাখ টাকা না দিলে ব্যবসায়ীকে ক্রসফায়ার করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি প্রদান করেন ক'দিন আগে। সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে মাঝরাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া যুবকের তরতাজা খুনের কথাও আমরা ভুলে যাইনি। এভাবে সারাদেশে কতিপয় পুলিশ সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাজানো অজুহাতে নিরীহ মানুষকে ক্রসফায়ার করে। মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ড তারই সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। মোদ্দা কথা, গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অপকর্মের দায়ভার তো বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী বহন করতে পারে না। তাদের অপরাধের জন্য এ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে দেওয়া যাবে না।
পুলিশের অপরাধের কারণ ও প্রতিকার খতিয়ে দেখা যাক। পুলিশের বেতন-ভাতাদি অপর্যাপ্ত কিনা যাচাই করা যেতে পারে; অবৈধভাবে ধনসম্পদ অর্জনের হীনচেষ্টা; পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে না নেওয়া; পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুলিশ কর্তৃক তদন্ত। যে কারণে অনেক সময় সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে পুলিশের অপরাধের শাস্তি হয় না। ফলে তাদের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব কারণে পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবহারসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। এ জন্য সরকারি বিধি মোতাবেক উপযুক্ত বেতন-ভাতার ব্যবস্থা গ্রহণ; পুলিশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের তদন্তের দায়িত্ব জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, র্যাব বা সোয়াতের মতো সংস্থা; সামরিক বাহিনীর যোগ্যতাসম্পন্ন অফিসার কর্তৃক অভিযোগ তদন্ত করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হোক।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশ ছাড়া অন্য সংস্থা কর্তৃক তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে। এ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিচারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে। এভাবেই বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী হোক আস্থা ও নিরাপত্তার প্রতীক।
প্রবাসী, আবুধাবি, ইউএই
মন্তব্য করুন