ডিসেম্বর ২০২০ ছিল জাতীর প্রাপ্তিতে পদ্মা সেতুর মতো অনন্য এক অর্জন। দুর্নীতির অহেতুক মিথ্যা অপবাদ দিয়ে অনেক জল ঘোলা করে দাতাগোষ্ঠী যখন অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়, তখন সেতুটি করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী দেখিয়েছেন ইস্পাতসম দৃঢ়তা। সামনে থেকে জাতিকে জুগিয়েছেন অসীম সাহস। ফলে নিজের টাকায় পদ্মা সেতুর মতো একটা অর্জন আমাদের জন্য অনেক গৌরবের, অহঙ্কারের। এত বড় একটা প্রাপ্তির সময়ে অন্য একটা খবর দেশের মানুষের বিশেষত শিক্ষাবিদ-গবেষকদের জন্য ছিল বেদনার। খবরটি ছিল বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে; এমনকি ভুটানেরও নিচে। যে সাতটি নির্ণায়কের ভিত্তিতে গ্লোবাল জ্ঞানসূচক ২০২০ করা হয়েছে, তার মধ্যে উচ্চতর শিক্ষায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৮টির মধ্যে ১২৯তম। উল্লেখ করার মতো ব্যাপার, এ নিয়ে সংশ্নিষ্ট কারও মাথাব্যথা দেখা গেল না। শোনা গেল না আশার বাণী। জ্ঞানসূচকে তলানি মানে, হয় দিন দিন আমরা মূর্খতা লাভ করছি অথবা জ্ঞান তৈরিতে শূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি। তবে কি আমরা অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছি? আমজনতা হয়তো বলবে, জ্ঞান তৈরির কারখানাগুলোর লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির ফসল। রাজনীতিই একমাত্র কারণ- সেটা বোধ করি ভুল কারণ। রাজনীতিবিদরা জ্ঞান তৈরিকে অনুৎসাহিত করেছেন, এমন কোনো তথ্য নেই। তবে হ্যাঁ, রাজনীতি যখন গবেষকের পেশা ও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে ব্যবহূত হয় তখন ভিন্ন কথা।
প্রথমটি সম্ভবত মনস্তাত্ত্বিক ও কাজের প্রতিকূল পরিবেশ। ঔপনিবেশিকতা বহু আগে বিলুপ্ত হলেও মনন ও চরিত্রে আমরা এখনও অপরিবর্তনশীল। যেমন উচ্চতর ডিগ্রি শেষে ৯৯ শতাংশ গবেষক ফিরে যান দেশসেবার আশায়; কিন্তু মানসিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় দৈন্য সহকর্মীদের নেতিবাচক ক্রিয়াকলাপে অনেকেই বছরও টিকতে পারেন না। তুলনামূলক 'অ-মেধাবী'রা বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে কাজের পরিবেশ অসহনীয় করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থার (ইউজিসি) ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দুটি পর্যবেক্ষণ তাৎপর্যপূর্ণ- ১. গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির ঘটনা দিনদিন বাড়ছে; ২. ৪৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের পিএইচডি নেই। উন্নত বিশ্বে মাস্টার্স শ্রেণিতে পড়াতে হলে পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক, আর আমরা...। এমতাবস্থায়, দক্ষ মানবসম্পদের চিন্তা ও জ্ঞান উৎপাদনের সম্ভাবনা কম। সামাজিক মাধ্যমে জানা যায়, ৩৮তম বিসিএসে ২৬০ জন পুরকৌশলীর প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি। রাষ্ট্র বছরের পর বছর টাকা খরচ করে বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত করল, কিন্তু তাদের অর্জিত জ্ঞান ব্যবহূত হবে প্রশাসনে! যেহেতু সরকারি চাকরি হালে বেশ লাভজনক (অর্থ ও ক্ষমতার দাপট), তাই তাদের দায়ী করার যেমন সুযোগ নেই; তেমনি বিশেষায়িত শিক্ষা কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে কাজে লাগবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার ঘাটতিও আছে। তৃতীয়ত, জবাবদিহি ও যুগোপযোগী আইনের অভাব। যেহেতু সরকারি চাকরি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, সেহেতু জ্ঞান উৎপাদন বা কাজ না করলেও মাস শেষে বেতন ঠিকই হয়। অনেক শিক্ষক/গবেষক বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েও দেশে ফিরে নির্লিপ্ত হয়ে পড়েন বিভিন্ন কারণে। অথচ তাদের মেধাকে ব্যবহার করে অনেক কিছু সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির চেয়ে পদ্ধতিগত দুর্বলতা বেশি দায়ী। যেহেতু পিএইচডি এককভাবে গবেষণা পরিচালনার হাতেখড়ি; অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিজস্ব শাস্ত্রের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় প্রয়োগ অপরিহার্য। এতে ব্যক্তির জ্ঞান যেমন শানিত হয়, তেমনি পেশাগত দক্ষতাও বাড়ে। সমৃদ্ধ হয় দেশ ও প্রতিষ্ঠান। যেহেতু ভালো কাজের স্বীকৃতি দেশে বিরল আর রাজনীতি করলে অনেক কিছুই সহজে পাওয়া যায়, সেহেতু পিএইচডির পর অনেকেই সহজ পথটা বেছে নেন। কেননা, জ্ঞান উৎপাদন চরম ধৈর্যের পরীক্ষা। চতুর্থত, আস্থাহীনতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় যে শিক্ষকের পাঠদান সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল, তিনি প্রায়শ সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের গুরুত্বের কথা বলতেন। তা ছাড়া বাঙালি দু'জন গবেষক একত্রে কাজ করলে কৃতিত্ব ভাগাভাগিতেও দেখা যায় জটিলতা। উন্নত দেশগুলোতে এগুলো সম্পর্কে লিখিত নীতিমালা রয়েছে। পঞ্চমত, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে গবেষণালব্ধ তথ্যের কিঞ্চিৎ ব্যবহার। সম্ভবত আমরাই একমাত্র দেশ, যেখানে সর্বজনীন নীতিমালা প্রণয়নে বৈজ্ঞানিক তথ্যের ব্যবহার উপেক্ষিত। অনেকেই বলেন, গবেষণার ফলাফল রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ কাজে ব্যবহূত না হলে আমরা কেন সময় নষ্ট করব? কথাটা অমূলক নয়। একটা রাষ্ট্রে বিভিন্ন পেশার লোকজন থাকবে। রাষ্ট্রের নীতি তৈরিতে সব পেশার প্রতিনিধিত্ব আবশ্যক। বলাবাহুল্য, একটা ছোট কাজেরও সামাজিক গুরুত্ব বহুবিধ হতে পারে। জনগণের নীতিমালায় গবেষণালব্ধ উপাত্তের ব্যবহার অনেকটা বাংলা প্রবাদ দশের লাঠি একের বোঝার মতো। অর্থাৎ একদিকে যেমন বিজ্ঞানীর কাজের স্বীকৃতি, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কল্যাণকর রাষ্ট্র। সরকারের উচিত শিল্প ও চাহিদাভিত্তিক গবেষণার ওপর জোর দেওয়া। এতে বেসরকারি খাত এগিয়ে আসবে।
অনেকেই বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের ২-৫ জন গবেষক আছেন। কথাটা ঠিক, কিন্তু যারা বলেন তারা হয়তো জানেন না, কোনো বনে ১০-২০টা গাছ থাকলে সেটাকে যেমন বনভূমি বলা যায় না। তেমনি গুটিকয়েক গবেষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কল্যাণ বা জ্ঞানসূচকে এগোনো দুরূহ। মহান সংবিধানের ১৭(বি) অনুচ্ছেদে শিক্ষার যুগোপযোগিতার কথা আছে। আপাতদৃষ্টিতে উচ্চশিক্ষায় বিষয়টি উপেক্ষিত। আবার অর্থের অপ্রতুলতাও অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলায় একটা কথা আছে- ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। আমরা যদি ইরানের দিকে তাকাই, দেখতে পাই বছরের পর বছর অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যেও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের আকাশচুম্বী সাফল্য। যেমন করছে নিজেদের উন্নতি, তেমনি অবদান রাখছে বিশ্বব্যাপী জ্ঞানচর্চায়। মূলত নিজস্ব শাস্ত্রে বিশ্বের স্বনামধন্যদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে তারা দ্রুত এগোচ্ছে। আমরা এই সুযোগটা কেন নিই না? দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট ১৫ হাজার ২৯৩ জন শিক্ষক রয়েছেন। প্রতি দু'জনে মিলে বছরে অন্তত একটা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাময়িকীতে প্রকাশ করলে দিন শেষে তা সংখ্যায় অনেক। বলাবাহুল্য, আমাদের জনশক্তির অনন্য সম্পদ হচ্ছে তরুণ কর্মশক্তি। সনদসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে ভালো ফল অবশ্যম্ভাবী। শুধু দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।
পদ্মা সেতুর একক কৃতিত্ব, সন্দেহাতীতভাবে প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দিতেই হবে। বিশ্বকে যেমন আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ নিজস্ব অর্থায়নে সেতু করে দেখিয়ে দিয়েছেন; জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষে জাতি আপনার দিকে তাকিয়ে। আপনার ইস্পাতসম দৃঢ়তা এ ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজন। বাঙালির ভাগ্যোন্নয়নে আপনাকে বারংবার ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আপনার দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের কারণে সম্পদের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে দেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। আপনার কাছে তাই সবিনয় ও সনির্বন্ধ আবেদন, শিক্ষাব্যবস্থা তথা জ্ঞানসূচকের বিষয়টি ধর্তব্যে নেওয়ার; নতুবা জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়লে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটরি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া