পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকন্দর আলীর কর্মস্থল তদানীন্তন আসাম প্রদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলার করিমগঞ্জে সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম। বিভাগোত্তরকালে করিমগঞ্জ ভারতভুক্ত হয়। ভারতীয় নাগরিক হিসেবেই মুজবতা আলীর জীবন কেটেছে। নিয়তির নির্মম পরিহাসে তিনি ছিলেন পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন। '৪৭-পরবর্তীকালে তার আত্মজন ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ। সৈয়দ মুজতবা আলীর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারতীয় নাগরিক হিসেবেই ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ঢাকায় তার বর্ণাঢ্য জীবনলীলার অবসান হয়। বিয়ে করেছেন বটে, কিন্তু সেই অর্থে সংসারধর্ম পালন করতে পারেননি। নির্ভরতা থাকলেও স্ত্রীর স্কন্ধে যাবতীয় গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে মুজতবা আলী যে নির্বিকার, নিশ্চিন্ত থাকতেন, তা নয়। দুঃখ-শোক-হতাশা-অক্ষমতা যতদূর সম্ভব তিনি অপ্রকাশই রাখতে চাইতেন। অন্তর্দহনে দগ্ধ হওয়া ভিন্ন আর পথ কী? সম্ভবত দুঃখকে ভুলে থাকার জন্যই জমজমাট মজলিসে সরস বাক্যজানে, অধিকাংশ সময় পানীয় সহযোগে নিজেকে বুঁদ করে রাখতেন। শিশুসুলভ সরলতায় আপন অসহায়তা ব্যক্ত করে পুত্রতুল্য ভাগ্নে সোলায়মান চৌধুরীর সাহায্য কামনা করেছেন।
"তোমরা বাবারা কিছু একটা করে আমাকে বাঁচাও। আমি এখানে (বোলপুর, শান্তিনিকেতন) বসে বসে করি কী! সেই যে সিলেটিতে আছে- হুকনাৎ ফালাইয়া জাল/ গাছো উঠি দিলা ফাল! জাল পড়েছে ঢাকা-রাজশাহীজুড়ে। আর আমি বোলপুরের গাছে 'ফাল' দিয়ে উঠছি।" এ সময় রাবেয়া আলী রাজশাহীতে কর্মরত এবং নতুন বাড়ি করেছেন বা করছেন ঢাকায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে মুজতবা-মানস বিশ্নেষণ করলে এই সংগ্রাম তার চিত্তকে কতটা আন্দোলিত করেছিল- তার মূল্যায়ন সহজ হবে। এ সময় আত্মজনের অমঙ্গল আশঙ্কায় বহু বিনিদ্র দিনযামিনী যাপনের ফলে আতঙ্কিত মুজতবার মানসিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়েছিল।
খণ্ডিত বঙ্গকে মুজতবা আলী মনেপ্রাণে স্বীকার করে নিতে পারেননি। তার বিবেচনায় এই বিভক্তি বৃহত্তর বঙ্গ সমাজের কোনো কল্যাণই সাধন করেনি, বরং সহস্র অকল্যাণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে যে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বসবাস করেছে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা মননশীলতার জগতে যাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল প্রশ্নাতীত, ধর্মের নির্মোহকে অধর্মের আশ্রয় নিয়ে বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে একই সঙ্গে বঙ্গভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নস্যাৎ করে তাদের মননশীলতাকেও করা হয়েছে পঙ্গু। বাঙালি বলতে তিনি উভয় বঙ্গ ও ভঙ্গবহির্ভূত অঞ্চলের বঙ্গভাষীদেরই নির্দেশ করেছেন। যে দেশেই বাস করুক না কেন, যাদের মাতৃভাষা বাংলা তারাই বাঙালি। সৈয়দ মুজতবা আলীর চিন্তা-চেতনা এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি প্রথমাবধিই পাকিস্তানপন্থিদের অস্বস্তির কারণ ছিল। এদের হিংস্র থাবা থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার স্ত্রী-পুত্রদ্বয় বরাবরই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় ভারতীয় নাগরিকের পুত্র-পত্নী হিসেবে তারা ছিলেন সন্দেহভাজন।
স্বাধীনতা সংগ্রামকালে পারিবারিক সংকটের কথা স্মরণে রেখেও প্রবল উত্তেজনায় মুজতবা তার আশাবাদকে শৃঙ্খলিত করতে পারেননি। '৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে স্মরণ করেছেন পাঠান বীর ওসমান খাঁর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা, যিনি স্বাধনীতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সিলেটের মহাসংগ্রামে মোগল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে বীরের ম্লানীয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। পানির সঙ্গে অপরিচিত মোগল বাহিনীকে বিধ্বস্ত করার মানসেই ওসমান তাদের হাওর অঞ্চলে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে প্রাণ বিসর্জন দেন। গর্বিত মুজতবাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তার প্রিয় বর্ষা ঋতুর জন্য- যে ঋতু পাঞ্জাবিদের হৃদকম্পের কারণ। মুজতবার প্রত্যাশা- ওসমান যুদ্ধে হারেন শীতকালে মার্চ মাসে, এবার শুধু অপেক্ষা বাঙালিরা 'ঘন বর্ষায়' কী সুযোগ নেয়। এ সময় অন্য একটি লেখায় মুজতবা আলী বাঙালিদের গৌরবময় সংগ্রামী ভূমিকার উল্লেখ করেছেন। অবাঙালির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ তাদের নিজস্ব পথ খুঁজে নিচ্ছিল।

সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪)

৬ জুন '৭১-এ পশ্চিম জার্মানির এক বান্ধবীকে লেখা পত্রে মুজতবার উদ্বেগ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে পশ্চিম জার্মানি সরকারের প্রেরিত অর্থের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি ঘৃণা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি ও সমর্থনও বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। ১৯৭১ সাল ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবনে সর্বাধিক সংকটময় সময়। একটা আশঙ্কা আলী সাহেবের মনে তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছিল যে, হানাদার বাহিনীর নির্মম হাত থেকে তার পরিবারের কেউই পরিত্রাণ পাবে না। এ সময় তার এক ভাগ্নে আবু সয়ীদ মাহমুদ প্রাণের ভয়ে ঢাকা থেকে কোনোক্রমে সপরিবারে লন্ডন চলে যান। আলী সাহেবের সঙ্গে তার নিয়মিত পত্র যোগাযোগ ছিল। এসব পত্রে তৎকালীন মুজতবা-মানস সুস্পষ্ট। মাহমুদের বক্তব্য, "(মামার) চিঠিতে শুধু সন্তান-বাৎসল্য কিংবা সন্তানদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ পায়নি, তাতে ছিল সার্বিকভাবে দেশের জন্য ব্যাকুলতা। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে লিখেছেন, আমার এই বৃদ্ধ বয়সে আমি দেশের জন্য কিছুই করতে পারছি না। যদি কোনোক্রমে 'মালদহ' দিয়ে রাজশাহী যেতে পারতাম- তবু মনে হয় কিছু করতে পারতাম। বার্ধক্যের জন্য কেউ আমাকে নিতে চায় না।"
হতাশায় মুহ্যমান মুজতবা আলীর মনে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়ে ওঠে, স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। প্রকৃতপক্ষে মানসিক দিক থেকে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। এ অবস্থায় মুজতবা অনুরাগীরা মানসিক প্রশান্তির জন্য তাকে একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করে দেন। শ্রীযুক্ত দ্বারিক মিত্র একটি ট্রানজিস্টার এবং তার ব্যক্তিগত স্টেনোকে মুজতবা আলীর সাহায্যার্থে দিয়েছিলেন। আলোচ্য সময়ে মুজতবা আলী প্রসঙ্গে শ্রীযুক্ত মিত্র বলেন :আলী সাহেব অত্যন্ত উদ্বেগের মধ্যে... সারাক্ষণ বাংলাদেশের ম্যাপ সামনে রেখে বসে থাকতেন। যেখানেই আক্রমণ হতো... সেখান থেকে তার ছেলেরা কতটা নিরাপদ, কিংবা বিপদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটা, তাই ভাবতেন। এবং রাতের পর রাত বিনিদ্র কাটিয়েছেন। ... তিনি সারাক্ষণ নানা দেশ থেকে বাংলাদেশের খবর শুনতেন। ... ডিকটেড করতেন এবং স্টেনো লিখে নিতেন। ... তাতে ছিল শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রশংসা, জাতিসংঘের নিষ্ফ্ক্রিয়তার জন্য প্রচণ্ড ক্ষোভ, পাকিস্তানি বর্বরতার প্রতি অন্তহীন ঘৃণা। সেই লেখাগুলো হারিয়ে যায়। অন্যথায় মুজতবা চরিত্রের একটা অনালোকিত দিকের সন্ধান তার গুণগ্রাহীরা লাভ করতেন।
এক সময় মুজতবা আলী সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক স্ত্রী-পুত্রদের ঢাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনতেই হবে এবং এ বিষয়ে তখন সিঙ্গাপুরে কর্মরত তার ভ্রাতুষ্পুত্র সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ আলীকে অবহিত করে চিঠি লেখেন। এ সময় মুজতবা আলী বাংলাদেশের চলমান নিষ্ঠুরতার কথা লিখছেন না বলে জনৈক পাঠক 'দেশ'-এর সম্পাদকের কাছে অনুযোগ করেন। মুজতবাভক্ত পাঠকদের এ ধরনের অভিযোগ-অভিমানের উত্তর না দিলেও তার অন্তর্লোকে নিরন্তর যে ক্ষরণ হচ্ছিল, দরদ দিয়ে তা বোঝার চেষ্টা করেছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন।
বাঙালির প্রতি মুজতবার দুর্বলতা ছিল সর্বজন পরিচিত। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রণী, মুক্তবুদ্ধির পূজারি বাঙালি সমাজ উপমহাদেশের অবাঙালিদের কাছে অনেক সময় অকারণেই ভীতিপ্রদ মনে হয়েছে। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা বাঙালির চরিত্র হননে তৎপর হয়ে উঠত। মুক্তি সংগ্রাম চলাকালে "হিন্দু' নিধনের আচ্ছাদনে চলছিল 'বাঙালি নিধনযজ্ঞ'।- 'এ দেশের হিন্দুকে খতম করে ইয়াহিয়া পেতেন ডাবল সুখ- একাধারে হিন্দু এবং বাঙালি, দুই দুশমনের জন্য লাগত মাত্র একটা বুলেটের চর্চা।"
বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের প্রতি মুজতবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা উল্লিখিত তার 'পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়'-তে। তিনি লিখেছেন, 'কোথায় সন্দ্বীপ, কোথায় বরিশালের অজপাড়া গাঁ- ওসব জায়গা থেকে ছাত্ররা পড়াশোনা করতে আসে সদরে, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকায়। তারাই একদিন ছড়িয়ে দিয়েছিল আপন আপন গ্রামে মুক্তি সংগ্রামের আহ্বান। ধন্য তারা, জয় হোক তাদের।'
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। সৈয়দ মুজতবা আলী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে মনুষ্যত্ব তথা মানবসভ্যতার নিকৃষ্টতম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে কামনা করেছেন- 'আমাদের যেন রাজলোভ না হয়। ... পরাধীনতার বেদনা আমরা জানি। আমরা যেন কাউকে পরাধীন না করি।' মুজতবার স্বাধীনতাকামী চিত্তলোক স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় কী আনন্দেই না উদ্বেলিত হয়েছিল! অনতিক্রম্য কারণে সৈয়দ মুজতবা আলী ভারতের নাগরিক হলেও সিলেট তথা বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসা, গভীর সহানুভূতির অভাব ছিল না। তার অন্তিম বাসনার মধ্যেও এই অনুভূতিরই প্রকাশ।
মুজতবা-জননীর সমাধি বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার শহরে। জীবদ্দশায় যে দেশে বাস করতে পারেননি, জীবনান্তে সেই দেশের মৃত্তিকায় মাতৃসান্নিধ্যে অন্তিম শয্যা গ্রহণের বাসনাও ড. আলীর বহু অপূর্ণ কামনা-বাসনার মতোই অপূর্ণই থেকে গেছে। ১৯৭৪-এর ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বৈচিত্র্যময় জীবনলীলার পরিসমাপ্তি ঘটে। আজীবন তিনি মাতৃভাষার সেবা করেছেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন অকুতোভয় অগ্রণী সৈনিক। মৃত্যুর পরও শেষ শয্যা রচিত হয়েছে মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ আবুল বরকত ও শফিকুর রহমানের পাশে ঢাকার পুরোনো গোরস্তানে।
প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়