
প্রচণ্ড আন্দোলন, রক্তক্ষরণ এবং দাবির মুখে বাংলা যেদিন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত পেল, সেদিন বোধ হয় অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন- আমরা বড় রকমের মাইলফলক অর্জন করেছি। পাকিস্তানি প্রতাপে যে ভাষা বিলুপ্ত হতে চলেছিল, হারাতে বসেছিলাম আমরা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলদের; সেই মুহূর্তে ওইটুকু স্বীকৃতি ছিল একটা বড় প্রাপ্তি। কারণ সেই থেকে ক্রমেই লোপ পেতে শুরু করে বাংলাকে উর্দু কিংবা আরবি বর্ণমালায় লেখার হাস্যকর প্রয়াস। বাংলা ভাষার সেই কথিত ইসলামীকরণের উদ্ভট পরিকল্পনাই ছিল বিস্ময়কর। কিন্তু কেবল হাস্যকর কিংবা বিস্ময়কর বলে বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ এর পেছনে যে একটি কূট-কল্পনা কাজ করছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। উদ্দেশ্যটা ছিল তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মানুষকে তার শিকড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা। কাজেই লড়াইটা কেবল ভাষার ছিল না; ছিল সংস্কৃতিরও। সায়েন্স ফিকশনের মতো হয়তো লেখা হতো কোনো সাংস্কৃতিক ফিকশনও; যেখানে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ দেশের মানুষের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আমরা হয়তো পেতাম কোনো মরু অঞ্চলের কথা। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার তীরে বাস করেও আমরা যেন হয়ে যেতাম নিজ দেশে পরবাসী। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের সেই দুর্গম পথ ধরেই আমরা পৌঁছে গেলাম এক মসৃণ বাস্তবতায় যখন দেশ হলো স্বাধীন। ১৯৬১ সালে যে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ এসেছিল পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের অনুচরদের কাছ থেকে; ১০ বছর পর সেই রবীন্দ্রনাথের গানই হলো আমাদের জাতীয় সংগীত। ১৯৭১-এর পর আমরা নিশ্চিত হলাম- আমাদের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন যাই-ই হোক না কেন; ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আমরা শিকড়ের সন্ধান পেলাম ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ছিল বটে, কিন্তু জাতিরাষ্ট্র ছিল না কখনও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই জাতিকে দিলেন একটি জাতিরাষ্ট্র। আমরা সানন্দে ও কৃতজ্ঞচিত্তে পেয়ে গেলাম বাংলাদেশকে।
আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূরণ হতে চলেছে; কিন্তু আমাদের পরিচিতি, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে নতুন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মাত্র সাড়ে তিন বছরে এর প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর যেন দৃশ্যপট পাল্টে গেল। অকস্মাৎ আমাদের জাতীয় পরিচিতির ওপর আঘাত এলো বড় রকমের। মুহূর্তেই আমরা বাঙালি থেকে বাংলাদেশি হয়ে গেলাম। জয় বাংলা স্লোগান হয়ে গেল বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এ তবে কিসের অশনি সংকেত? আমরা কি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম পাকিস্তানের দিকে! আসলে বাংলাদেশি এই পরিচিতিটি এক অর্থে ভুল নয়, যদি তা আমাদের দেশের ভৌগোলিক পরিচয়কে নির্দেশ করে। কিন্তু এর চেয়েও বৃহত্তর অর্থে আমরা বাঙালি। সেটিই প্রকৃত অর্থে আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। আর এই বাঙালি জাতীয়তাবোধকে কেন্দ্র করেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
সত্য বটে, বাঙালি অন্যান্য দেশেও রয়েছেন। আছেন ভারতে এবং অন্যত্র। কিন্তু তারা তো সেসব দেশের নাগরিক। আমরাই তো একমাত্র বাঙালিত্ব পরিচয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। আমাদের এই আদি ও অকৃত্রিম পরিচিতিতে পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য ছিল না কোনোক্রমেই। আমাদের সৌভাগ্য, সেই ক্রান্তিকাল কাটিয়ে উঠেছি। সেই সঙ্গে আমরা আশা করব, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন ঘটতেই পারে, কিন্তু আমাদের পরিচিতির যেন আর পরিবর্তন না ঘটে। আমাদের পরিচিতি কোনো রাজনৈতিক দলের দান নয়। বাঙালির পরিচিতি তার নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে। জয় বাংলা স্লোগানও মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে চলে আসছিল। সেখানে জিন্দাবাদ- এই ফার্সি শব্দ-সম্পৃক্ত ধ্বনি দেওয়া অর্থহীন। বাংলাদেশের একটি মূল সমস্যা হচ্ছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিচয়ও আমরা পাল্টে ফেলি। ছবি টানানো আর নামানোর রাজনীতিতে আমরা দেশের ইতিহাসকে দলের আবর্তে আবদ্ধ করি। সেই বৃত্তায়িত অবস্থা থেকে বাঙালিকে বেরিয়ে আসতেই হবে। রাজনৈতিক নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হলেই আমরা আগামীতে আর কখনও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় ইশতেহারে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করব না।
পরিচিতি প্রসঙ্গ নয় কেবল; আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যও এখন বড় রকমের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সত্য বটে, বিশ্বায়নের কারণে আমরা নিজেদের মধ্যে হয়তো আগেকার মতো আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারব না; বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাংস্কৃতিক জল-হাওয়া আমাদের প্রভাবিত করবে। সেটা যেমন আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারে, তেমনি আমাদের দেশজ সংস্কৃতিকে প্রান্তিক অবস্থানেও নিয়ে যেতে পারে। স্বীকার করতেই হবে, সে রকম প্রভাব থেকে আমাদের সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথও মুক্ত ছিলেন না। তার বিলেতবাসের ছাপ তার সুর ও সংগীতে পাই মাঝেমধ্যে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো বিক্রি হননি কারও কাছে; বিকৃত করেননি নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে। আমরা যারা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ, আমাদের জন্য এই বিশ্বায়ন যেন মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলা ভাষার মতো বাংলাদেশের সংস্কৃতি, পোশাক-আশাকে এসেছে পরিবর্তন, যা আমার মতো একজন প্রবাসীকেও শঙ্কিত করে বারবার। ভাষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আসছে ইংরেজি ও হিন্দি থেকে। এখনকার ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে থেকেও এমন কৃত্রিম গর্বের ভাব করে; সে বাংলা জানে না এবং তাতে তাদের মা-বাবার যেন গর্বে বুক ফুলে যায়। কিন্তু এ তো কোনো শ্নাঘার কথা নয়। ইংরেজি মাধ্যমে আমরা অনেকেই পড়েছি সেই পাকিস্তান আমলে। কিন্তু নিজের ভাষাকে তো কখনোই অবজ্ঞা করিনি। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা কিংবা মাতৃভাষা বিকৃতভাবে উচ্চারণ করা আদৌ কোনো কৃতিত্বের বিষয় যে নয়, সে কথাটা মা-বাবাকেই তুলে ধরতে হবে সন্তানদের কাছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া কোনো দোষের কথা নয়। দোষের কথা হচ্ছে বাংলাকে, বাঙালি সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়ার ভান করা। কেবল ইংরেজি নয়, চ্যালেঞ্জ এসেছে হিন্দির কাছ থেকেও। স্কুল নয়; ঘরে বসেই হিন্দি চলচ্চিত্র কিংবা ধারাবাহিক নাটক দেখে শিশুরা হিন্দিতে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কোনো ভাষা জানাটা অপরাধ নয়। কিন্তু নিজের ভাষাকে অবজ্ঞা করাটা মস্ত বড় অপরাধ। এ জন্যও অভিভাবকরা দায়ী। তারা যেমন হিন্দি নাটক-সিনেমায় আসক্ত হয়ে পড়েন, তেমনি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মধ্যেও নিজ থেকেই এ আসক্তি জন্মায়। বাঙালি এক সময়ে উর্দু ভাষার প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে হিন্দিকে তার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নয়। এসব বিষয় সত্যিই বাংলাদেশের মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ভাষার সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জ এসেছে বাঙালি সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও, বিশেষত পোশাকে। এ রকম একটা চ্যালেঞ্জ এসেছিল আশির দশকেও, যখন কিছু বাঙালি পাকিস্তানি কায়দায় 'কাবুলি' পোশাক পরা শুরু করে। আমাদের সৌভাগ্য, সে ধারা দ্রুতই বিলুপ্ত হয়। এবার ভারতীয় হিন্দি ছবির প্রভাবে বাঙালি মেয়েদের পোশাকে এসেছে অন্য রকম পরিবর্তন। কেবল সালোয়ার-কামিজ নয়, এর সঙ্গে লেহেঙ্গা এবং দীর্ঘ এক ধরনের পোশাক, খানিকটা ভারতীয়-পাকিস্তানি, খানিকটা আরব স্টাইলের পোশাক। এর প্রসার ও পসরা এতটাই বাড়-বাড়ন্ত; আশঙ্কা হচ্ছে, বাঙালি নারীর চিরায়ত পোশাক শাড়ি বোধ হয় বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়, বিয়ের কনেও আজকাল শাড়ি পরছে না। পরছে পাক-ভারতীয় পোশাক। সেই সঙ্গে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পরিবর্তে এখন শোনা যায় মেহেদি অনুষ্ঠান, যা সরাসরি পাকিস্তানি সংস্কৃতি থেকে এসেছে। একুশের দিনেই কেবল শাড়ি পরে শহীদ মিনারে যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা প্রধান নয়। ভাষাশহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান তখনই দেওয়া হবে যখন আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিতে পারব। ভাষার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম হয়েছিল। এখন কি তাহলে সংস্কৃতির জন্য হতে হবে সামাজিক সংগ্রাম? সমাজের এই দায়বদ্ধতা রাষ্ট্রের কাছে থেকেই যাচ্ছে, এটা নিশ্চিত করা- কোনো শক্তিই যেন আমাদের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন না করে। আবার যেন আমরা বাঙালি হই।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক
মন্তব্য করুন