বুধবার সমকালে প্রকাশিত খবরে জানা গেল, স্বাস্থ্য খাতসহ ১৩ খাতে দুর্নীতির ৭৫ উৎস চিহ্নিত করে দুর্নীতি প্রতিরোধে ১১৫টি সুপারিশসহ ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পেশ করেছে। একে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা জানি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু দুদকের প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে প্রতীয়মান, দুর্নীতিবাজদের কালো হাত এখনও অনেক প্রসারিত। আমরা দেখেছি, করোনা দুর্যোগকালে স্বাস্থ্য খাতে একের পর এক দুর্নীতির চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। তাই দুদকের তালিকায় স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতির শীর্ষে থাকাটাই স্বাভাবিক। ওয়াসা, কাস্টমস, রেলওয়ে, ভূমি, সড়ক ব্যবস্থাপনাসহ অন্য খাতও ওই প্রতিবেদনে রয়েছে। করোনার সুরক্ষাসামগ্রী, পরীক্ষা থেকে শুরু করে কেনাকাটা ও বিতরণ ব্যবস্থায় যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, তা নিয়ে এর আগে আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই লিখেছি। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এ খাতটি অসাধু চক্রের মুঠোবন্দি হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত বাইরের বলবান দালালচক্রও।

স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি দেশের নাগরিকের অধিকার- তা শুধু আমাদের সংবিধান প্রদত্ত অঙ্গীকারই নয়; বিশ্বের সব দেশেই নাগরিক সমাজের মৌলিক অধিকার। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, এ খাতের এমন কোনো স্তর নেই যেখানে গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় না। এর ফলে শুধু যে মানুষের হয়রানি-ভোগান্তি হচ্ছে, তা-ই নয়; আর্থিক অপচয়ও ঘটছে। এ খাতে নিয়োগ থেকে শুরু করে পদায়ন, বদলি সর্বক্ষেত্রে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তাও নতুন নয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা উপকরণ-যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়মের উৎকট চিত্রও সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে কম উঠে আসেনি। সরকারি ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি করে অসাধুদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। এমনকি অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মেধা যাচাই না করে বিপুল অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগও পুরোনো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসাধুরা সিন্ডিকেট গড়ে ঠিকাদারি কাজ পছন্দের লোক বা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আখের গুছিয়েছে। নকল-ভেজাল-নিষিদ্ধ ওষুধের ছড়াছড়ি নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে সংশ্নিষ্ট সব মহলের সীমাহীন ব্যর্থতা। স্বাস্থ্য খাতের মতো নিবিড় জনস্বার্থসংশ্নিষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংঘটিত দুর্নীতি মানুষের জীবনের জন্যও চরম হুমকি।

আমরা জানি, অপচিকিৎসা, রোগীকে জিম্মি করে বিরাট অঙ্কের অর্থ আদায়ের মতো অবিমৃষ্যকারিতার নজির বেসরকারি কোনো কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিকের ক্ষেত্রে রয়েছে। ওষুধের মান যথাযথ না হলেও নামসর্বস্ব কোম্পানিগুলোকে মানসম্মত বলে সনদও দেওয়া হয়েছে। যেখানে আমাদের ওষুধ শিল্পের উৎপাদিত ওষুধ অনেক দেশেই রপ্তানি হচ্ছে, সেখানে এমন তুঘলকি কাণ্ডের বিরূপ প্রভাব কী হতে পারে ও তা জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ; এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নিষ্প্রয়োজন। চোরাই পথে আসা নকল ওষুধে বাজার সয়লাব- এমন খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হওয়ার পর ঔষধ প্রশাসন নামকাওয়াস্তে অভিযান পরিচালনা করেই দায়মুক্ত হতে চেয়েছে। এক কথায়, এ খাতে চলছে চরম নৈরাজ্য। আমরা মনে করি, এসব ব্যাপারে দুদক যে সুপারিশ উপস্থাপন করেছে, তা বাস্তবায়নে অনতিবিলম্বে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ নৈরাজ্য দূর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসনের সমন্বয়ে শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করে এ ব্যাপারে করণীয় নিশ্চিত করতে হবে কালক্ষেপণ না করে। দুদকের প্রতিবেদনে আর যেসব খাতের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে একই রকম ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

আমাদের দেশে দুর্নীতির পথ রুদ্ধ করতে আইনি কাঠামোর অভাব না থাকলেও জবাবদিহির ক্ষেত্রে যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, দুদকের প্রতিবেদন তা সাক্ষ্যবহ। এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে- রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজরা যতই শক্তিশালী হোক, তাদের মূলোৎপাটনে দায়িত্বশীল কোনো সংস্থাই নয় নখদন্তহীন। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি দরকার আমূল সংস্কার ও কঠোর নজরদারি। এ জন্য সর্বাগ্রে জরুরি সুশাসন নিশ্চিত করা। এও মনে রাখতে হবে, কোনো খাতেই যোগসাজশ ছাড়া দুর্নীতি হয় না। দুদকের প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তা তো অনুমান নয়; প্রমাণনির্ভর। কাজেই দুর্নীতিবাজদের মূলোৎপাটন মোটেও দুরূহ বলে আমরা মনে করি না। চাই শুধু রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা।

বিষয় : দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন

মন্তব্য করুন