কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য অপরিসীম এ কথাটি অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য আমদানি নয়, রপ্তানি করার সক্ষমতাও এখন আমাদের রয়েছে। কৃষির এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে। সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তার বলয় রচনা ও সুরক্ষা এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুবাদে কৃষিবিদরা আজ সর্বজন স্বীকৃত। স্বীকৃতির এই মর্যাদা অর্জনের পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), ময়মনসিংহের প্রতিষ্ঠা এবং ষাটের দশকের মধ্যভাগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ও তৎকালীন ঢাকায় তেজগাঁও কৃষি কলেজের (বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রদের দুই দফাভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে এ লড়াইয়ের সূচনা হয়। দুই দফা দাবির অন্তর্ভুক্ত ছিল- এক. কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশকালে গেজেটেড পদমর্যাদা প্রদান, দুই. সমমর্যাদার পেশাজীবীদের সঙ্গে একীভূত বেতন স্কেল ও সংগতিপূর্ণ টেকনিক্যাল পে প্রদান।
এই দুই দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ১৯৬৪ সালের ১৭ জুন থেকে ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয়, যা লাগাতারভাবে ১৭২ দিন অব্যাহত থাকে। মলয় বৈশ্য নামে একজন ছাত্রকে আত্মাহুতি দিতে হয় এ আন্দোলনে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশপদে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা এবং টেকনিক্যাল পে প্রদানের দাবি জানালে তিনি তা মেনে নিয়ে অচিরেই সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন। এই অর্জনের দীর্ঘকাল পরে ২০১১-১২ মেয়াদে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ১৩ ফেব্রুয়ারিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১২ সাল থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি 'কৃষিবিদ দিবস' হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এ দেশের কৃষিবিদ সমাজ বিভিন্ন ফসলের শত শত জাত উদ্ভাবন ও প্রবর্তন এবং উন্নত চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। এ কারণেই আমাদের জমি ক্রমহ্রাসমান হলেও প্রতি বছর উৎপাদন বেড়েই চলছে। দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ভরে উঠেছে ফসলের বৈচিত্র্যে। একইভাবে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতেও উন্নতি পিছিয়ে নেই। গ্রামে গ্রামে পোলট্রি ফার্ম, গাভি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে পশুসম্পদের এবং পুকুর, বিল, বাঁওড় এবং মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষের কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়ায় এ খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। সমুদ্র জয়ের ফলে মেরিন ফিশারিজ খাতের উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বসতবাড়িতে ফল ও সবজি চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় পারিবারিক পুষ্টির প্রাপ্যতা বেড়েছে। দেশে কৃষিশিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ সেবা যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি প্রয়োজনীয় উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরণের জোগানও বাড়ছে প্রতিনিয়ত, যেখানে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত রয়েছেন কৃষিবিদরা।
কৃষিক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য অগ্রযাত্রার পরও কৃষিবিদদের নানান দুঃখ-কষ্টের যেন অন্ত নেই। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কিছুটা কমে এলেও এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতিতে রয়েছে ধীরগতি। এ বছর ছয়টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিপাকে রয়েছেন বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশনে কর্মরত কৃষিবিদরা। এ ছাড়া বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্পসহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যাওয়া কৃষিবিজ্ঞানীরা তাদের পাওনা টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। করোনার প্রভাবে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কৃষিবিদরা রয়েছেন আরও বিপাকে। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১০টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কয়েক হাজার কৃষিবিদ এখন বেকার, আর প্রতি বছরই এ সংখ্যাও বাড়ছে। এসব সমস্যার আশু সুরাহা না হলে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সব বাধা পেরিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে কৃষি ক্ষেত্রে অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য কৃষিবিদদের ভূমিকা আরও শানিত ও জোরদার হবে মুজিব শতবর্ষে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান,  কৃষি রসায়ন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
mticsau@yahoo.com

বিষয় : কৃষিবিদের সফলতা ও সংকট

মন্তব্য করুন