- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ড. আহমদ শরীফ :বাংলাদেশের বিবেক
জন্মশতবার্ষিকী
ড. আহমদ শরীফ :বাংলাদেশের বিবেক

শততম জন্মতিথিতে ড. আহমদ শরীফের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য। তিনি আমাদের সময়ের এক শ্রেষ্ঠ মনীষী- সমাজমনস্কতা দ্রোহ, প্রথা বিরোধিতা যার মানসের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য- এমন মেধাবী পণ্ডিত, হৃদয়বান মানুষ, বিবেকশাসিত পুরুষ, আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষক সমকালের চেনা-জানা মানুষের মধ্যে খুব বেশি চোখে পড়েনি। তিনি সবসময়ই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ, অপ্রিয় সত্য-কথনে অকুণ্ঠ ও অভ্যস্ত। তার এই বক্তব্য সমাজে-রাষ্ট্রে অনেক সময় তীব্র প্রতিক্রিয়া জাগিয়েছে। বিপন্ন হয়েছেন নিজে, এমনকি কখনও কখনও জীবন সংশয়ও হয়েছে তার। ধর্ম, শাস্ত্র, রাজনীতি ও ব্যক্তি সম্পর্কে তার মত ও মন্তব্য সহ্য করার মতো যুক্তিবাদী উদার মনোভাব আমাদের অনুদার-জড়বদ্ধ সমাজে এখনও গড়ে ওঠেনি। তিনি পঞ্চাশ দশক থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেছিলেন এবং তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলমান ছিল। নিজস্ব দর্শন চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে বোদ্ধা সমাজের কাছে তিনি ছিলেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত এবং মৃত্যুর পরেও এ ধারা বহমান।
বাংলাদেশে ড. আহমদ শরীফের মতন হাতে গোনা চার থেকে পাঁচজন লিখিয়ে পাওয়া যাবে যারা কোনো অবস্থাতেই সরকারি বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বেড়াজালে নিজেদের জড়াননি, তাই তারা মননশীল লেখক হিসেবে বা তাদের চিন্তাসমৃদ্ধ গ্রন্থগুলো লেখাপড়া জানা মানুষের কাছে অদ্যাবধি অজ্ঞাত ও অপঠিত থেকে গেছে। একইভাবে ড. আহমদ শরীফের রচিত সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-দর্শন এবং ইতিহাসের ওপর শতের অধিক মননশীল গ্রন্থগুলো শুধু অপঠিতই নয়, অগোচরেও থেকে গেছে।
ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মার্কসবাদের যৌক্তিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, বক্তব্য ও লেখনীতে। তার রচিত একশ'র অধিক গ্রন্থের প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দিয়ে প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থা বিশ্বাস-সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন এবং আন্তরিকভাবে আশা পোষণ করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য। পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বই দশকের শেষ অবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে অজস্র লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ-পরিবর্তনকামীদের কাছে তার পুস্তকরাশির মধ্যে বিচিত্র চিন্তা, স্বদেশ অন্বেষা, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ বাংলার সুফি সাহিত্য, বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা, বাংলার বিপ্লবী পটভূমি, এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা এবং বিশেষ করে দুই খণ্ডে রচিত 'বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য' তার অসামান্য কীর্তি। তবে এ কথা নির্দি্বধায় বলা যায়, প্রখ্যাত গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মানসপুত্র হিসেবে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণাকর্ম তাকে কিংবদন্তি পণ্ডিত হিসেবে উভয়বঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে তিনি মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনা করে গেছেন।
ড. আহমদ শরীফ এমন একজন প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীর নাম, যিনি বাংলাদেশের প্রতিটি অন্যায়-অবিচার, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন কখনও এককভাবে, কখনও সম্মিলিতভাবে। সরকার বা প্রশাসনের সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে একটি স্বাধীন মর্যাদাশীল জাতির বিবেকী কণ্ঠ হিসেবে তিনি তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার অকল্পনীয় সাহস কখনও তার স্বগোত্রীয়দেরও বিব্রত করেছে, অনেকে সমালোচনা করেছেন হঠকারী বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্পষ্টবাদিতা তাকে তার সহকর্মী এমনকি সমগামীদের থেকেও বিচ্ছিন্ন করেছে, কিন্ত তিনি কখনও হতাশ হননি কিংবা শহুরে মধ্যবিত্ত লোকদের স্বরূপ উদ্ঘাটনে বিরত থাকেনি।

পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অনুপ্রেরণায় ড. আহমদ শরীফ চল্লিশ দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ অবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসহ প্রায় সব বিষয়ে নিরন্তর লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ-পরিবর্তনকামীদের কাছে তার পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। তিনি জীবৎকালে বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেছিলেন, তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'সম্মানসূচক ডিলিট' ডিগ্রি। তার বিশাল পুস্তকরাশির মধ্যে যেমন মানুষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির কথা রয়েছে, তেমনি তৎকালীন পাকিস্তানের বেড়াজাল থেকে পূর্ব বাংলার মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত 'নিউক্লিয়াস' (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ)-এর সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
১৯৬২ সালে গঠিত 'অপূর্ব সংসদ'-এর (অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার) উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৬৫ সালে রচিত তার 'ইতিহাসের ধারায় বাঙালি' প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ করার এবং 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটির কথা উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে তার মৃত্যু অবধি তিনি দেশের ক্রান্তিলগ্নে কখনও এককভাবে, কখনও সম্মিলিতভাবে তা প্রশমনের জন্য এগিয়ে গিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্বে সেই আন্দোলনমুখর সময়ে তিনি শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতার শপথ গ্রহণে নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বাধীনতার পর জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রাক্কালে গঠন করেছিলেন মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি। ১৯৭৬ সালে সামরিক শাসনের ভেতর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের শাসনের ভেতর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের একুশ উদযাপন জাতীয় কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান এবং ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করার জন্য ১৯৮১ সালে গঠন করেছিলেন নাগরিক কমিটি। এছাড়া তিনি দেশের সব প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন।
উপমহাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, দ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী, দার্শনিক, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধি ও নির্মোহ চিন্তার ধারক ড. আহমদ শরীফ গোটা কর্মজীবন ধরে জনগণের গভীর শ্রদ্ধা লাভ করেছেন। কথা ও কর্মে অবিচল, অটল, আপসহীন ও দৃঢ় মনোভাবের নাস্তিক ড. আহমদ শরীফ সবরকম মেকি প্রথা-সংস্কার-শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৯৫ সালে লিপিবদ্ধ করা 'ইচ্ছাপত্রে' মানবকল্যাণে মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করে গেছেন। সেই অসিয়তনামায় উল্লেখ্য ছিল- 'চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণপ্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরে কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।'
অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
মন্তব্য করুন