এটা সত্যিই অতীব দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় রাজনীতি করেন, তারা প্রায়শই রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের অপব্যাখ্যা হাজির করেন। পাকিস্তানি শাসনামলের পুরোটা সময় তো বটেই, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা একই অদূরদর্শিতা দেখিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতকেও তাদের এই প্রবণতায় ব্যত্যয় ঘটেনি। মুসলিমপ্রধান এই দেশে ওলামা-মাশায়েখদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কম নেই। সেই সুযোগ গ্রহণ করে ধর্মের নামে রাজনীতি করা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবর্গ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সন্মান জানানোর পরিবর্তে, তারা কোটারি স্বার্থের হয়ে মাঠে নেমেছে। এর সর্বশেষ নজির আমরা দেখেছি আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ইস্যুতে।
গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখেছি- বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনা নিয়ে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত উগ্রতার সৃষ্টি করা হয়েছিল। কোনো কোনো দুস্কৃতকারীরা এই সুযোগের দুর্ব্যবহার করে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়েছিল। তখন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন- 'এটা একটি বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এটি রাজনৈতিক ইস্যু। বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এর লক্ষ্য।' (ডেইলি স্টার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০)।
অবশ্যই যে কোনো ব্যাপারে একটি গণতান্ত্রিক দেশে দ্বিমত থাকতে পারে, যে কোনো 'ইস্যু'তে ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বীরা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন। তবে এ নিয়ে কোনো সাংঘর্ষিক বচসা পরিহার করাই শ্রেয়। বিশেষ করে যেখানে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই, সেই জাতির পিতার প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধা প্রদর্শন তো প্রশ্নাতীতভাবেই পরম বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীতে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোসহ এমন খুব কম দেশই আছে যেখানে জাতির পিতা, দেশনেতা, মনীষী বা বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রদ্ধা করা হয় না।
ইরানের মতো ইসলামিক দেশেও বর্তমানে ইমাম খোমেনি ছাড়াও শেখ সাদি, মাওলানা রুমি, হাফেজ ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, আবু সিনা (ইবনে সিনা) এদের অবয়ব-ভাস্কর্য আছে। তা ছাড়া ইরানে এখন তো সগর্বে সুরক্ষিত রয়েছে প্রাচীন ইরানি বা পারসিক সভ্যতার নিদর্শনগুলো, যেমন- পার্সিপোলিস, আপাদানা, ইসপাহান এবং অন্যান্য স্থানে মানব ভাস্কর্যের সমাহার। ঐতিহ্যবাহী মধ্যপ্রাচ্য ও সেন্ট্রাল এশিয়ার বহু দেশেই তাই।
ইরানে রেজা শাহের পতনের পর পাহলভিদের কয়েকটি মূর্তি ভাঙচুর হয়েছিল বটে, তবে তা ছিল রাজনৈতিক কারণে। কোনো ধর্মীয় কারণে নয়। বাগদাদে সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য-অবয়বকে নামিয়ে আনা হয়েছিল ধর্মীয় কারণে নয়, শুধু রাজনৈতিক কারণে। যেমন করে ইদানীং ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো কোনো স্থানে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদী-বর্ণবাদী বা দাস প্রথার সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও কারও এ-জাতীয় ভাস্কর্য-অবয়ব সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
সেন্ট্রাল এশিয়ার সব মুসলিমপ্রধান দেশেই রয়েছে মানব-অবয়বের ভাস্কর্যের বহু স্থাপনা অতীতের এবং অধুনা। উজবেকিস্তানে- যেখানে রয়েছে সমরখন্দ, তাসখন্দ, বোখারা, খিভা, তিরমিজ, যেখানে জন্মেছিলেন ইমাম বোখারি আল তিরমিজি, ইমাম বাহাউদ্দিন নকশবন্দি, আল-বেরুনি, মির্জা উলুগ বেগ, জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর (মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা)- সেখানে তো চতুর্দিকেই মনুষ্য-অবয়ব সমন্বিত ভাস্কর্যের উপস্থিতি। তাসখন্দে আমির তৈমুরের ভাস্কর্য হচ্ছে শহরের 'মহত্তম আকর্ষণ'। নিজে দেখেছি জন্মস্থান ফারগানায় মুঘল সম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের ভাস্কর্য-অবয়বে নববিবাহিত বহু যুগলের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। ওটা ওখানে প্রায় সামাজিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমি দীর্ঘকাল জেদ্দার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পৃথিবীর সব সদস্য মুসলিমপ্রধান দেশে ভ্রমণ করেছি। মানব-অবয়বমণ্ডিত ভাস্কর্য প্রায় সব দেশেই দেখেছি। ইন্দোনেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, মিসর, তুরস্ক, মাগরেরের দেশগুলো মালে, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনিসহ পশ্চিম আফ্রিকার সব মুসলিম অধ্যুষিত দেশ- কোথাও ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থার মুখোমুখি হইনি। প্রায় সর্বত্রই দেখেছি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য মানব-অবয়ব সমন্বিত ভাস্কর্যের উপস্থিতি। দেখেছি ইউরোপের বসনিয়া ও হারজেগোভিনা, আলবেনিয়ায়।
নব্বইয়ের দশকে সেন্ট্রাল এশিয়ায় ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সব মুসলিম দেশের আইডিবি, ওআইসিতে যোগদান এবং সহায়তা প্রদান প্রসঙ্গে বেশ ক'বার গিয়েছি। মনে পড়ে, তুর্কমেনিস্তানের প্রেসিডেন্ট সাপারমুরান নিয়াজভ অশ্বারোহী একজন নেতার একটি সুন্দর ভাস্কর্য স্মৃতিস্মারক হিসেবে দিয়েছিলেন। আফ্রিকার গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট ওমর বঙ্গো আইডিবির নেতৃবর্গকে অতীব সুন্দর মানব-অবয়ব সমন্বিত ও প্রস্তর-নির্মিত মূর্তি উপহার দিয়েছিলেন। তুরস্কের বর্তমান গণতান্ত্রিক এবং ইসলামিক মূল্যবোধে গভীর বিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আমলে ভাস্কর্যবিরোধী কোনো কথা বা তৎপরতা কখনও দেখা যায়নি; বরং স্থাপনা হয়েছে।

এটা অনস্বীকার্য, যদি আমরা বাংলাদেশে ভাস্কর্য স্থাপনাবিরোধী অবস্থানে আসি, তাহলে তা অধিকাংশ মুসলিম দেশ এবং উম্মাহর চিন্তাধারার বিপরীতধর্মী হবে। অন্যান্য দেশে ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা হলেই যে তাদের অনুসরণ আমরা করব, তা নয়। তবে আমাদের উপলব্ধি করা উচিত হবে, সেসব দেশে প্রাজ্ঞ মুসলিম নেতৃবৃন্দ সবকিছু বিবেচনা করেই ভাস্কর্য সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব ধারণ এবং গ্রহণ করেছেন। শতাব্দী শতাব্দী ধরে তাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, তাদের ওলামা-মাশায়েখ-পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতামত ও নির্দেশনা হেলায় তুচ্ছ করা বা অভিসন্ধিমূলকভাবে তাদের বিরোধিতা করা সংগত নয়।
আমি কোনো ধর্মীয় শাস্ত্রজ্ঞ বা ইসলামী ধর্মীয় রীতিনীতি-অনুশাসনে বিশেষ জ্ঞানী বা অভিজ্ঞ কেউ নই। তবুও আমি একজন আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল মুসলিম এবং এই হিসেবে ভাস্কর্য, মূর্তি, ছবি, পেইন্টিং ইত্যাদি ব্যাপারে জানার চেষ্টা করেছি। আমি জেদ্দার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে দীর্ঘকাল অপারেশন এবং প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। তখন বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় জ্ঞানী-গুণী সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, আল-আজহার, উন্মুল কুরা, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা আলেমদের সঙ্গে ভাস্কর্য, ছবি, মূর্তি, ফটো ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে ভাস্কর্যই হোক বা মূর্তিই হোক বা ফটো, ছবি বা পেইন্টিংই হোক- মূল বিষয় হচ্ছে, কী কারণে এই সৃষ্টি হয়েছে। একে উপাসনাযোগ্য বা দৈব-শক্তিধারী বিবেচনা করা হয় কিনা বা 'শিরক'-এর কোনো সম্ভাবনা বা উদ্দেশ্য আছে কিনা?
সৌদি আরবেই তো সর্বত্র ফটোগ্রাফ-পেইন্টিং আছে। পৃথিবীখ্যাত ভাস্করদের তৈরি শিল্পনির্দেশক ভাস্কর্য দেখেছি রাস্তাঘাটে। সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ, বর্তমান বাদশাহ এবং যুবরাজ- এই ত্রয়ীর ফটো তো সব সরকারি কার্যালয় এবং প্রায় সর্বত্রই সযত্নে রক্ষিত। ছবি, প্রতিকৃতি, ফটো বা অঙ্কিত শিল্পকেও তো ইচ্ছা করলে পূজা বা কোনো কোনো ধর্মে দৈবশক্তিধারী বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। অধুনা তো রোবটও তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলো শুধু মানুষের অনুকরণ করে তা নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কথোপকথন বা নির্দেশক কর্ম-সমাধাও করে। এ ধরনের একটি রোবট রিয়াদ ও ঢাকায়ও আনীত হয়েছিল। মূল কথা হচ্ছে- কী উদ্দেশ্যে তাদের তৈরি করা হয়েছে।
বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রশ্নে সাংঘর্ষিক অবস্থা দূরে থাক, বিতর্ক সৃষ্টিও মোটেও অভিপ্রেত নয়। তার প্রতি সর্বপ্রকার সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন প্রত্যেক বাঙালির অন্তরের একান্ত অভিলাষ। বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সব মানুষও তাই-ই চাইবে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমপ্রধান দেশগুলোসহ সারাবিশ্বে গৃহীত ও প্রতিষ্ঠিত একটি প্রক্রিয়ায়, অর্থাৎ ভাস্কর্য-স্থাপনার মাধ্যমে যদি তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকার কথা হয়, তাহলে এ নিয়ে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয় অহেতুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে বিজ্ঞজনোচিত ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে সহনশীলতার সঙ্গে বিতর্কের অবসানের নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা আশা করব, দেশে ধর্মীয় রাজনীতি যারা করেন, বিলম্বে হলেও তাদের বোধদয় ঘটবে। পাশাপাশি সমগ্র জাতিই এই মুজিববর্ষে বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে সংগত কারণেই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ায় জাতির পিতাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দ্বিধা করবে না। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ ও আদর্শিক বিভক্তি থাকতে পারে; কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি করতে হলে এর প্রতিষ্ঠার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানানোর বিকল্প নেই। দলমত নির্বিশেষে সবার চিন্তা ও কর্মে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।
সাবেক সচিব; সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

বিষয় : ধর্মের অপব্যাখ্যা এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা

মন্তব্য করুন