অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা- এই পাঁচ মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্ন তথা খাদ্যের অধিকার মানুষের সবার আগে। মানুষের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য জরুরি হলেও সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য এর চেয়ে বেশি জরুরি হলো নিরাপদ খাদ্য। টেকসই জীবন, সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ শুধু দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হন। এ কারণে প্রতি বছর মারা যান চার লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুর ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়; যার মধ্যে প্রতি বছর প্রাণ হারায় এক লাখ ২৫ হাজার শিশু। ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার- এমন দুই শতাধিক রোগের জন্যও দায়ী অনিরাপদ খাবার। আইসিডিডিআর,বির তথ্য মতে, দেশে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে; এ ছাড়া পাঁচ বছরের নিচে ৫২ শতাংশ শিশুই অপুষ্টির কারণে রক্তশূন্যতায় ভোগে। তাই সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি ও অধিকার।
কৃষি এখন বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। সনাতন কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির স্থলে দেশে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় আমাদের উৎপাদন বাড়ছে এবং মানুষ পেশা হিসেবে কৃষিকে শুধু এখন আর জীবিকা নির্বাহের জন্য না ভেবে বাণিজ্যিক স্তরে উন্নীত করেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হলো, টেকসই খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের জনগণের জন্য পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা উন্নত রাষ্ট্রে উপনীত হবো শুধু অর্থনীতির দিক দিয়ে তা নয়, আমরা উন্নত হতে চাই পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যের জাতি হিসেবেও। তাই নিরাপদ খাদ্যই এখন আমাদের প্রধান ভাবনা।
খাদ্যে বিভিন্নভাবে ভেজাল বা ক্ষতিকর দ্রব্য মেশানো হচ্ছে- এ কথাটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যদিও নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন ও ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করে। এরপর ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে জাতীয়ভাবে নিরাপদ খাদ্য দিবস ধারাবাহিকভাবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও এ বছর রাজধানীতে দিবসটির মূল অনুষ্ঠান হচ্ছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। আনুষ্ঠানিকতা যা-ই হোক না কেন, করোনা মোকাবিলায়ও নিরাপদ খাদ্যের দাবিটি আরও জোরালো হয়েছে, মানুষও নিজ থেকেই অনেক বিষয়ে সচেতন হয়েছে বা হচ্ছে। সরকারের বাজার মনিটরিং ও অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনাসহ নানা কার্যক্রম প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু সীমিত পরিসরে এ কার্যক্রম দিয়ে সারাদেশের মানুষের নিরাপদ খাবার অত্যন্ত কঠিন। এ জন্য সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হয়ে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বর্তমানে ভয়াবহ দিক হলো খাদ্যে বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে খাবার উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের প্রতিযোগিতা লেগেই আছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এ বিষয়গুলো কিছুটা দমিয়ে রাখা গেলেও তা একেবারে বন্ধ করা যায়নি। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে গ্রহণ করার যে কোনো স্তরে ক্ষতিকর দ্রব্য এবং জীবাণু দ্বারা খাদ্য বিষাক্ত বা দূষিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েই গেছে। আর অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিরই কারণ নয়, বরং দেহে নানা রোগ-ব্যাধিরও অন্যতম কারণ।
তবে কৃষিতে ঢালাওভাবে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হচ্ছে- এ কথাটি এখন আর সঠিক নয়। বরং আমাদের দেশের কৃষকরা উন্নত দেশ যেমন- জাপান, কোরিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশের তুলনায় কম পরিমাণে কেমিক্যাল ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন করেন। বাজারের তাজা মাছ কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, সেটি কিন্তু মাছের গুণগত মান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। তাই বাজারে তাজা মাছ বা সবজি কেনার আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাছ বা সবজি উৎপাদনে কী কী ফার্টিলাইজার বা ফিড দেওয়া হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে এগুলোর পরিবেশ কেমন ছিল। যেখানে আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিল্প বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয় এবং বাতাসে ভারী ধাতুর উপস্থিতি অনেক বেশি, সেখানে এই পরিবেশে যা কিছুই উৎপাদন করা হোক না কেন, তার মধ্যে ওই বিষাক্ত উপাদান মিশে থাকবে এটিই স্বাভাবিক।
আর তাই খাবারে যদি সহনীয় মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণে সামান্য পরিমাণ ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত থাকে, তবুও তাতে উপকারের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণে আমাদের তা নষ্ট করা বা ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না। এখন প্রশ্ন হলো, খাবারে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণে ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত আছে, তা আমরা কীভাবে বুঝব? এর জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত গবেষণা, যা হতে হবে স্বীকৃত ল্যাবরেটরিতে। বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ডের তথ্য মতে, কৃষি ক্ষেত্রে মাত্র আটটি স্বীকৃত ল্যাব রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সারাদেশে এ ধরনের স্বীকৃত ল্যাব আরও বেশি স্থাপন করতে হবে।
বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার এই দেশে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। সরকারের নানা কার্যক্রমে কৃষিতে আমাদের অগ্রগতি সাফল্যজনক। পূর্বাচলে তিন একর জমির ওপর রপ্তানি প্রসেসিং জোন তৈরি হচ্ছে। নিরাপদ খাবারের প্রচেষ্টাটি আমরা শুরু করেছি, যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে হবে। আশার কথা হলো, গত ৬০ বছরে আমাদের গড় আয়ু বেড়ে এখন হয়েছে ৭২.৪, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের গড় আয়ু বর্তমানে যথাক্রমে ৭০ ও ৬৭। সরকার নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও উদ্যোগী হয়ে এ কার্যক্রম আরও বেগবান করবে- এটাই আমরা প্রত্যাশা করছি।
লেখকদ্বয়- অধ্যাপক, কৃষি রসায়ন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও
নিরাপদ খাদ্য বিশেষজ্ঞ
 mticsau@yahoo.com

বিষয় : নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার এখনও অনিশ্চিত

মন্তব্য করুন