- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বঙ্গবন্ধুর দেশ গঠন ও উন্নয়ন ভাবনা
মুজিববর্ষ
বঙ্গবন্ধুর দেশ গঠন ও উন্নয়ন ভাবনা

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাড়ে তিন বছরের স্বল্প সময়ে তুলনামূলক এত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভবপর করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তথ্য-উপাত্তভিত্তিক জাতির পিতার দেশ গঠন ও উন্নয়ন ভাবনা তুলে ধরার আগে অক্লান্তকর্মা এ মহান রাষ্ট্রনায়কের সুচারুভাবে পরিকল্পনা সম্পাদনের কার্যকারণ সম্পর্ক আলোচনা করে নেব।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি নয় মাস সেখানে নির্জন কারাগারে ছিলেন। আইয়ুব খান তার আত্মজীবনী 'ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স' গ্রন্থে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু নয় মাস কারাগারে থাকা অবস্থায় অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন স্বাধীনতা লাভের বিষয়ে। এই সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি, নির্জন কারাবাসকালে অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ বা নিজ মনে চিন্তাভাবনার শ্রেষ্ঠাংশে ছিল তার দেশ ভাবনা। বাংলাদেশকে কীভাবে তিনি গড়ে তুলবেন, কীভাবে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করবেন, কেমন হবে অনাগত তথাপি অবশ্যম্ভাবী দেশটির পরিচালন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, কতদিনে, কী কী উপায়ে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণ-শাসনে নিস্তেজ দেশের অর্থনীতিকে সজীব-সতেজ করবেন, তারই পরিকল্পনা করেন নিঃসঙ্গ, একাকি। এ দেশের মানুষকে তার মতো করে কেই-বা আর জানতেন, বুঝতেন। তবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় এ জানাবোঝার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকতার যোগ থাকলে সেই 'হোম ওয়ার্ক' আরও কার্যকরী হতে পারে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী ইশতেহারে পূর্ব বাংলার অধিকার আদায় ও স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পয়েন্টগুলো সন্নিবেশের জন্য কাজ করেন শেখ মুজিব। ছয় দফা প্রণয়ন তার পূর্ব বাংলার চাহিদা ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার বিষয়ে গভীর উপলব্ধিকেই প্রমাণ করে। এর আগে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের বিদ্যমান সংবিধানেই ছয় দফা কার্যকর করা সম্ভব। ১৯৬৯ সালে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান শেষে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে যেই কথা সেই কাজ করেন। পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের বিদ্যমান সংবিধানের কিছু সংশোধনী এনে ছয় দফাকে সাংবিধানিকভাবে প্রয়োগযোগ্য করার প্রস্তাবনা তৈরি করেন।
এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ছয় দফার ভিত্তিতে একটি নতুন সংবিধানের খসড়াও করেন। এই ঘটনা পরম্পরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ গঠন ও প্রায়োগিক দেশ ভাবনায় বঙ্গবন্ধুর জন্য সহায়ক হয়েছিল।
মাত্র সাড়ে তিন বছরে অজস্র সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, প্রশাসনিক বিন্যাস ও উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাবলীল উপস্থিতি ও পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও শাসন ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস ইত্যাদি দ্রুতলয়ে করা সম্ভব হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা ছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনে প্রয়োজনীয় সদস্যপদ ও চুক্তি ছিল না। বিকল্প ব্যবস্থায় তখন বহির্বাণিজ্য পরিচালনা করতে হয়েছে। তিনি তদানীন্তন বিশ্ব বাস্তবতার চেয়েও অগ্রবর্তী থেকে সমুদ্রসীমা আইনসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় অত্যাবশ্যক আইন বিনির্মাণ ও অধ্যাদেশ জারি করেন। মাত্র দশ মাসে তার নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে প্রণীত হয় একটি অসাম্প্রদায়িক, সম-অধিকার সমুন্নতকারী, নূ্যনতম সংস্কারমুক্ত আমাদের পবিত্র সংবিধান।
সদ্য স্বাধীন দেশে জনবান্ধব ও ভারসাম্যমূলক প্রশাসন, অবকাঠামো সচলকরণ, নির্যাতিত মা-বোনদের পুনর্বাসন, শরণার্থী পুনর্বাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফেরত আনা, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের রাহুমুক্ত করে পুনর্গঠন, যুদ্ধাপরাধী বন্দিদের বিচার, উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর প্রত্যর্পণ ইত্যাদি প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুজ্জীবন, ভৌত কাঠামো, শিল্প, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা, খাদ্য ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, আর্থিক সহায়তা প্রদান, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়।
যুদ্ধোত্তর দেশে ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মকাণ্ড হাতে নেন বঙ্গবন্ধু। এজন্য সব পর্যায়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। গৃহহীনদের আবাসন সুবিধা, জরুরিভিত্তিতে নগদ টাকা, খাদ্য সহায়তা, শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে আর্থিক সহায়তা, মহকুমা সদরে অভিভাবকহীন নারীদের আশ্রয় প্রদান, বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে প্রভৃতি পেশার মানুষদের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা দেওয়া হয়। যাতে তারা নিজ নিজ পেশা অব্যাহত রাখতে পারেন।
একটি উদার ও অসাম্প্রদায়িক সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ১৯৭২ প্রণয়ন করেন। অস্ত্র জমাদান, যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্তীকরণ, সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন। অন্যদিকে ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করেন। বিমানবাহিনীর জন্য বারোটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, রাডার, এ এন-২৪ ও ২৬ বিমান, এম আই-৮ হেলিকপ্টার বিমানবাহিনীর জন্য সংগ্রহ করেন। জাতির পিতা ১৯৬৬ সালে প্রদত্ত ছয় দফায় তৎকালীন পূর্ব বাংলার নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপনের দাবি জানিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের তিনটি নৌঘাঁটি স্থাপন ও বানৌজা পদ্মা, বিশখালী, নোয়াখালী, পাবনা, এম আর আমিন, সুরমা, পটুয়াখালী, কর্ণফুলী ও তিস্তা নামে যুদ্ধজাহাজ যুক্ত করেন। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে উৎপাদন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করেন। উৎপাদন সচল করায় থোক টাকা বরাদ্দ, কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত ও খাতভিত্তিক শিল্প কারখানার পুনরুজ্জীবন ঘটান।
জাতির পিতার অন্যান্য অর্থনৈতিক উদ্যোগ হলো বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, মুদ্রা প্রবর্তন, আমদানি-রপ্তানি চালু, জনবান্ধব বাজেট প্রণয়ন, শিল্প কারখানা জাতীয়করণের মাধ্যমে শিল্পায়ন, জানুয়ারি ১৯৭৩ শিল্প বিনিয়োগ নীতিমালা ঘোষণা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, মুদ্রাস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মাথাপিছু আয় ২ দশমিক ৫ ভাগ বৃদ্ধি। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক (১২০ দশমিক ৫ হাজার ডলার ব্যয়) সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রদান, যুদ্ধকালীন বকেয়া ফি মওকুফ, দুই শিফটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, পহেলা নভেম্বর ১৯৭২ প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, ২২ মার্চ ১৯৭৫ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ প্রতিষ্ঠা (এ লক্ষ্যে ১৬ নভেম্বর ১৯৭৩ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন), ১৫নং রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে জাতীয় আণবিক শক্তি কমিশনের যাত্রা শুরু (১৯৭৩) হয়।
ওই সময় ১০৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন টাকা (মার্কিন ডলারে ১ দশমিক ২৯) ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়। যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ১৪৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই নাজুক অবস্থার মাঝেও দেশে ১৯৬৯ সালের তুলনায় ৬০ ভাগ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। মাথাপিছু আয় পাকিস্তান আমলের চেয়ে ২ দশমিক ৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের এ অগ্রসরমানতা ছিল অভাবনীয় ঘটনা।
যুদ্ধ-পরবর্তী নাজুক অবস্থার মাঝেও দেশে ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় মাসিক ৬০ ভাগ বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে মাথাপিছু আয় ২ দশমিক ৫ ভাগ ও জিডিপি ৫ দশমিক ৫ ভাগ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য মিসর, জার্মানি, মিয়ানমার ও সুদানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি করা হয়। মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের এ অগ্রসরমানতা ছিল অভাবনীয় ঘটনা। সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সোনার বাংলাদেশ গড়ার অভীষ্ট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১-এর কালরাতে ক্র্যাকডাউন শুরু হলে গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরপর প্রহসনের বিচারে পশ্চিম পাকিস্তানে তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয় সামরিক জান্তা সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রবল চাপে এ দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন জাতির পিতা। পূর্ণতা পায় আমাদের বিজয়ের আনন্দ।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দেশ পুনর্গঠনে যখন তিনি গভীরভাবে নিমগ্ন, মোকাবিলা করছেন নানামুখী সংকট ও ষড়যন্ত্র, সে মুহূর্তেই ঘাতকের বুলেটে প্রাণপাত হয় বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের আঠারো সদস্যের। ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের যেন সুষ্ঠু বিচার না হয় সেজন্য প্রণীত হয় কালো আইন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি গ্লানিমুক্ত হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ
মন্তব্য করুন