- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- দুর্নীতি দমনে নির্বাহী বিভাগের দায়
সুশাসন
দুর্নীতি দমনে নির্বাহী বিভাগের দায়

গত বছরসহ এ বছরের প্রথম দুই মাসে দুর্নীতির বিষয়টি মিডিয়ায় বহুল আলোচিত ছিল। গত বছর স্বাস্থ্য খাতের সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয় কারও অজানা নয়। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দুদকের তৎপরতায় একাধিক দুর্নীতির মামলাও হয়েছে। এসব মামলা কিছু আছে চার্জশিট দেওয়ার অপেক্ষায়, কিছু ক্ষেত্রে হয়তো-বা চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। প্রায় সবক'টি মামলাই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।
স্বাস্থ্য খাতের প্রধান দপ্তরের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিও উদ্ঘাটিত হয়। এর মধ্যে ছিল একজন ড্রাইভারের দুর্নীতি তথ্যবহুল ঘটনা। বেসরকারি খাতের ডাক্তারসহ কিছু ব্যক্তিও এখন আসামি হয়ে কারাবাসে রয়েছেন। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফার্মেসির মালিকরা বিনা লাইসেন্সে অবাধে ওষুধ বিক্রিতে জড়িত ছিলেন, এ তথ্যও উদ্ঘাটিত হয়েছে। তারা লাইসেন্স নবায়ন করতেও ভুলে গিয়েছিলেন। প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন করা বাধ্যতামূলক। ঠিক একই দোষে দোষী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। ওই সময় অর্থাৎ গত বছর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় বেশ জোরেশোরে অভিযান পরিচালনা শুরু করলেও হঠাৎ স্তিমিত হয়ে যায়। প্রথমে আসে একটি নির্বাহী সিদ্ধান্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ছিল যে, ওই মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ব্যতিরেকে অন্য কোনো সংস্থা ফার্মেসি সংক্রান্ত অভিযান চালাতে পারবে না। মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ফার্মেসি বা কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করা নিঃসন্দেহে বেআইনি। তাহলে মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতির প্রয়োজন। নিশ্চয়ই এ ধরনের অনুমতির কথা সংশ্নিষ্ট আইন-বিধি বা অন্য কোনো আইন বা বিধিতে নেই। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন।
এখন পর্যন্ত অভিযান থেমে যাওয়ার পর কতগুলো ফার্মেসি লাইসেন্স নবায়ন করেছে, কতগুলো লাইসেন্সবিহীন ছিল, সারাদেশে কতটি ফার্মেসি আছে- তা আমরা জানি না। জনস্বার্থে এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। এর ফলে এ খাতে যারা ব্যবসা করেন, তারাও সচেতন হবেন। অন্যদিকে, এ কথাও বলা যায় যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে দারুণভাবে কর্তব্যে অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এর জন্য কী ধরনের বা মাত্রার জবাবদিহি তারা করেছেন বা করবেন, তাও জনগণ জানে না। অথচ অনেক সময় রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে স্মরণ করিয়েছেন, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। এটা সংবিধান স্বীকৃত। এ ধরনের অস্বচ্ছতা দুর্নীতিকেই উৎসাহী করে, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরে সহায়তা করে। এ দেশে দুর্ভাগ্য এই যে, গণতন্ত্রকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও তা এখনও সম্ভব হয়নি বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। অন্যদিকে, দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ অনেক বছর আগেই করেছে। এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
এ মাসের ৯ তারিখে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। দুদকের চেয়ারম্যান অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারি সংস্থাগুলো দুর্নীতি প্রতিরোধ সংক্রান্ত দুদকের সুপারিশ আমলে নেয় না। অথচ এ বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধও সরকারি আইন, বিধি বা আদেশে নেই। বরং সরকারি আচরণ ও শৃঙ্খলাবিষয়ক বিধিতে দুর্নীতির কারণে বিভাগীয় মামলা করা ও প্রমাণ সাপেক্ষে শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে। প্রতি বছর দুদক বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য একাধিক সুপারিশ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করে। সেসব সুপারিশ কী কারণে নথিভুক্ত হয়, তা সবারই অজানা। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক দুর্নীতি পর্যবেক্ষণবিষয়ক সংস্থা অর্থাৎ টিআইর সুপারিশের বিষয়ে আমাদের নজরে আসে।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাভুক্ত একটি দক্ষতা বৃদ্ধি কর্তৃপক্ষ রয়েছে, কিন্তু দুদক কার্য পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হলেও সে বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক কোনো শাখা-প্রশাখা আছে কিনা তা জানা নেই। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ ও দুদক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে অবস্থান করছে। একে অন্যের সহায়ক শক্তি হিসেবে নয়।
এ মাসের ৯ তারিখে বিদায়ী দুদকপ্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে সরকারের ঘোষিত উন্নয়ন ও প্রশাসনিক নীতি সাংঘর্ষিক। কারণ, তা না হলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা দুদকের সুপারিশ বাস্তবায়নে নীরব থাকত না। এ ধরনের নীরবতা সরকারি নীতিনির্ধারকরা কেন সহ্য করছেন, তা অনুসন্ধান সাপেক্ষ। এ ধরনের অনুসন্ধান যে করা হবে না বা যাবে না, তা সহজেই অনুমেয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি সই করেছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। ভিশন ২০২১-এ বলা হয়েছে, সরকার রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে প্রত্যয়ী এবং সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সুসংহত করবে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা ১৬.৩ অনুযায়ী সরকার দুর্নীতি ও ঘুষ আদান-প্রদান বহুলাংশে হ্রাস করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। বাস্তবে এর বিপরীত চিত্রই দৃশ্যমান। সরকারি সংস্থাগুলো যে দুদকের সুপারিশ বাস্তবায়নে দারুণভাবে উদাসীন, এর কিছু উদাহরণও ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। দুদক চেয়ারম্যানের মতে, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি রোধে ১৪টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ ছিল। প্রায় নয় মাস অতিবাহিত হলেও সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ কাজটি করেনি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি জনস্বার্থবিষয়ক মামলার মাধ্যমে হাইকোর্টের নজরে আসার পর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়। সাম্প্রতিককালে হাইকোর্ট দুর্নীতি রোধে দুদকের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছেন, যা উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ কাজ হাইকোর্টকে করতে হবে কেন? নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব পরিধিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বিষয়টি কি আওতাভুক্ত নয়।
গত বছরসহ এ বছরে মিডিয়ায় আলোচিত দুর্নীতির মামলায় কিছু সংখ্যক সাবেক ও বর্তমান সাংসদের বিষয়ও জানা গেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক চাঞ্চল্যকর মামলা ছিল একজন সাংসদ, যিনি সম্প্রতি বিদেশি এক রাষ্ট্রের আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন। এ বছরের প্রথম ভাগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে বগুড়া-২ আসনের এক সাংসদের আগাম জামিনের আবেদন নিষ্পত্তি করার সময় সংশ্নিষ্ট বেঞ্চ মন্তব্য করেছেন, দুর্নীতির অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকেই ছাড় দেওয়া হবে না। সরকারি নীতিনির্ধারকরাও একই সুরে মাঝে মাঝে এ ধরনের উক্তি করেন, তবে কার্যত কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। দুদক চেয়ারম্যানের এ বিষয়ে সাম্প্রতিক মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের খেয়াঘাটের দুর্নীতি ও ক্যাসিনো সংক্রান্ত অর্থ পাচারের জামিন মামলায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ মন্তব্য করেন যে, জনমানুষের সাহায্য ব্যতিরেকে এ ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়।
অনেকটা এ ধরনের মন্তব্য আমরা বিগত ৫০ বছর ধরেই শুনছি। হয়তো ভবিষ্যতেও শুনব। এ মন্তব্য ছিল : সামাজিক আন্দোলন ছাড়া দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, দুদকের জন্মলগ্নে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন যে, দুদক একটি খোঁড়া হাঁস। সম্প্রতি এ ধরনের আরও একটি মন্তব্য ছিল: দুদককে দন্তবিহীন বাঘ হিসেবে দেখতে চাই না। যে বিষয়টি প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত, তা হলো জন্মলগ্নের দুদক এবং বর্তমানের দুদক এক নয়। অর্থাৎ খোঁড়া হাঁস বা দন্তবিহীন বাঘ বা এ ধরনের মন্তব্য বর্তমানের দুদকের প্রতি একেবারেই প্রযোজ্য নয়। যে কোনো অপরাধ দমন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার প্রধান নির্ণায়ককল্পে সফল তদন্তসহ আদালত কর্তৃক উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের সর্বমোট মামলার শতকরা হার।
টিআইবির ২০০২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুদকের পূর্বসূরি দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পরিসংখ্যানে ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে শাস্তি প্রদানের হার ছিল সর্বনিম্ন ৪২ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ। বর্তমানে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানা যায়। তবে সব মহলের একটাই আক্ষেপ, তা হলো মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলার শতকরা হার। সবার সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। তদন্তকারী সংস্থাসহ আদালতের দক্ষতাই এ ক্ষেত্রে অধিকতর সাফল্য অর্জনে সহায়ক বলে মনে হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
মন্তব্য করুন