- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- সব আবিরন ন্যায়বিচার পাক
সৌদিতে গৃহকর্মী হত্যার প্রথম রায়
সব আবিরন ন্যায়বিচার পাক
বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনে প্রাণ হারানো আবিরন বেগম দুই বছর পরে হলেও যে ন্যায়বিচার পেয়েছেন, এ বিষয়টিকে আমরা মন্দের ভালো হিসেবে দেখতে চাই। বাংলাদেশি জনশক্তির অন্যতম প্রধান গন্তব্য ওই দেশটিতে এই প্রথম কোনো বাংলাদেশি গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি হলো। রোববার রিয়াদের একটি আদালতে অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড এবং গৃহকর্তার কারাদণ্ড, জরিমানাসহ এই রায় দেশটিতে বাংলাদেশি জনশক্তির মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা এখন প্রত্যাশা করি, আবিরনের মতো অন্যরাও নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পাবেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি রায়েই স্বস্তি প্রকাশ করে ক্ষান্ত থাকতে পারে না। মনে রাখতে হবে- সৌদি আরবে গিয়ে আরও বহু নারী কর্মী আবিরনের পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হয়েছেন। সমকালে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে প্রায় ৫০০ নারী কর্মীর লাশ এসেছে। এদের অধিকাংশই সৌদি আরবে কর্মরত ছিলেন। স্পষ্টতই নির্যাতনে প্রাণ গেলেও তাদের মৃত্যুসনদে স্বাভাবিক মৃত্যু বা আত্মহত্যার কথা ছিল। আমরা মনে করি, সরকার বা দূতাবাস তৎপর হলে আরও অনেক অভাগা নারীর স্বজনরা ন্যায়বিচার পেতেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সেখানে আমাদের নারীরা হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হলেও দোষীদের শাস্তি দূরে থাক, মামলাও হয়নি। অথচ আলোচ্য রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো- সংশ্নিষ্টরা সক্রিয় হলে ন্যায়বিচার সম্ভব। বিশেষত আবিরনের লাশ দেশে আসার পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যেভাবে তৎপর হয়েছিল এবং তাদের তদন্ত ও সুপারিশের ভিত্তিতে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস যেভাবে আইনি লড়াই শুরু করেছিল, তা নজিরবিহীন। এমন নজির আরও দেখতে চাই আমরা। অস্বীকার করা যাবে না, অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিত কর্মী বা নিহত কর্মীর পরিবার মামলার ঝামেলায় যেতে চান না। দূতাবাসের সীমিত জনবলের অজুহাতও অমূলক নয়। কিন্তু আবিরন হত্যা মামলার রায় প্রমাণ করেছে, সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা থাকলে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার সম্ভব। সৌদি আরবের দূতাবাসে নিযুক্ত বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মধ্যে আমরা সেই সংবেদনশীলতাই দেখতে চাই। শুধু হত্যা ও নির্যাতনের বিচার নয়; কর্মীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও বাংলাদেশের দূতাবাসকে সদা সচেতন ও সক্রিয় থাকতে হবে। বস্তুত মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া আমাদের নারী শ্রমিকরা কীভাবে প্রতারণা এবং শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তা এখন আর সংশ্নিষ্টদের অজানা নয়। নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই যে কাজের জন্য প্রবাসে পাড়ি জমান, অধিকাংশই সে কাজে নিযুক্ত হতে পারেন না। বরং অমর্যাদাকর অনেক কাজে জোর করে নিয়োজিত করা হয়। আবার যে পারিশ্রমিক পাওয়ার কথা, তাও মেলে না। সবচেয়ে উদ্বেগ ও বেদনাদায়ক তাদের ওপর নির্বিচার যৌন নির্যাতন। স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পরিবার-পরিজন ফেলে পরদেশে গিয়ে দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অনেকে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। ২০১৫ সালে যখন মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের দরজা খুলে গিয়েছিল, আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে ফিরে আসা নারীর সংখ্যা এবং নির্যাতিত ও নিহতের তালিকা। ফিরে আসা নারীদের কাছে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা শোনা যায়, তাতে তাদের ফিরে আসতে পারাই স্বস্তির। কিন্তু শুধু এদের ফেরার মধ্য দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের নির্যাতন ও বঞ্চনার নিষ্পত্তি হতে পারে না। বিশেষত নির্যাতন ও হত্যার শিকারদের ন্যায়বিচারের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ পেতেই হবে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যখন নারীর দৃপ্ত পদচারণা, তখন জনশক্তি খাতে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে গিয়ে তাদের এভাবে নিপীড়নের শিকার হতে দিতে পারি না। মরুপ্রান্তরে গুমরে গুমরে কাঁদা, লাশ হয়ে ফেরার জন্য শ্যামল বাংলার সর্বজয়া নারীদের জন্ম হয়নি।
মন্তব্য করুন