
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের কথা আমরা কে না জানি। পৃথিবীর বহু মানুষ এখনও অবাক হয় যে, মানুষ ভাষার জন্য জীবন দিতে পারে। ভাষা আন্দোলনের শহীদরা পৃথিবীর বুকে এ রকমই এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। এরই স্বীকৃতি হিসেবে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ দেশের জনগণ হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বের। সেইসঙ্গে একটি বিষয় আবার আমাদের জন্য দুঃখের। সেটি হলো, বাংলাদেশে বসবাসরত ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ব্যবহূত কমপক্ষে ৩৭টি আদিবাসী ভাষা খুবই অবহেলা আর অনাদরে আছে। আমি নিজে একজন সাঁওতাল আদিবাসী হয়ে বলতে পারি- আমার ভাষা চর্চা, সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। সাঁওতাল বাদে অন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোরও একই অবস্থা।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ আদিবাসীদের ভাষা সম্পর্কে খুব একটা জানেন না। অনেকে আবার আদিবাসী ভাষা শুনে নাক-মুখ কুঁচকান। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ২০১০ সালে নতুন করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলে সেখানে আদিবাসী ভাষা বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়। এর ফলে দেখা যায়- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতালি ও সাদরি ভাষাভাষী আদিবাসীদের এই ছয়টি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। সে অনুযায়ী ২০১৭ সালে সাঁওতালি ভাষা বাদ দিয়ে অন্য পাঁচটি ভাষার প্রাক-প্রাথমিকের বই শিশুদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা-সংক্রান্ত বিতর্কের কারণে সাঁওতালি ভাষার বই প্রকাশের ব্যাপারটি স্থগিত রয়ে যায়। তবে সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়া, পাঠ্যপুস্তক সঠিকভাবে বিলিবণ্টন না করা ইত্যাদি কারণে এটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। তবে সরকার যদি আরও একটু আন্তরিক হয়, তাহলে আদিবাসী ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে বাংলা ভাষার চর্চার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেই একইভাবে আদিবাসী ভাষাগুলোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। বাংলা একাডেমির আদলে আদিবাসী ভাষা একাডেমি গঠন; আদিবাসী ভাষায় কমপক্ষে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা চালু করা; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসী ভাষা বিভাগ চালু করা; আদিবাসী ভাষার সাহিত্যের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও অনেক আদিবাসী নিজ উদ্যোগেই নিজেদের সাহিত্য রচনা করছে এবং সেগুলো পুস্তক আকারে প্রকাশও করছে। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে আদিবাসীরা তাদের ভাষাকে শুধু বই-পুস্তকের মধ্যে না রেখে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ ও সামাজিক মাধ্যমেও ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা আদিবাসী ভাষাগুলোকে অনেকটাই নতুন জীবন দান করছে। এতে করে আদিবাসী ভাষা বিপন্ন হওয়ার প্রবণতাও কমছে। সাঁওতালি ভাষা এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পরে সাঁওতালি ভাষাতেই মনে হয় সবচেয়ে বেশি তথ্য ডিজিটালভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সাঁওতালি ভাষায় উইকিপিডিয়ার ভার্সন (যঃঃঢ়ং://ংধঃ.রিশরঢ়বফরধ.ড়ৎম) তৈরির মাধ্যমে। এর আগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায়ও উইকিপিডিয়ার ভার্সন তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সাঁওতালি উইকিপিডিয়ায় পাঁচ হাজারের অধিক নিবন্ধ আছে। প্রতিনিয়ত এটিতে নতুন নতুন নিবন্ধ যোগ হচ্ছে। ফলে দিন দিন এটি সমৃদ্ধ হচ্ছে, যা সাঁওতালি ভাষার টিকে থাকার লড়াইয়ে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। সাঁওতাল জনগণও আজ খুশি যে, তাদের মাতৃভাষায় ইন্টারনেটে তাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো কিছু সম্পর্কে তারা তাদের ভাষাতেই তথ্য খুঁজে পাচ্ছে। সাঁওতালি ভাষার ডিজিটাল রক্ষাকবচ হিসেবে সাঁওতালি উইকিপিডিয়া আজ তাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে।
পৃথিবীতে বর্তমানে সাত হাজারের বেশি জীবিত ভাষা আছে। এর মধ্যে চার হাজারের মতো ভাষাই হচ্ছে আদিবাসীদের। কিন্তু এর মধ্যে বেশির ভাগ ভাষাই আজ হুমকির সম্মুখীন। প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের বিপন্ন ভাষাগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া বাংলাদেশের ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টি বিপন্ন হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বিপন্ন ভাষাগুলো রক্ষায় তারাও সেভাবে কোনো উদ্যোগ এখনও গ্রহণ করতে পারেনি। পৃথিবীর সব মানুষের যেমন সমানভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তেমনি পৃথিবীর সব ভাষারও বেঁচে থাকার সমান অধিকার আছে। আমাদের দেশের জাতীয় আইনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন, দলিল-দস্তাবেজেও সব ভাষার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাই সরকারের কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি এ দেশের আদিবাসী ভাষাগুলো রক্ষায় বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানাই।
তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ
maniksoren@gmail.com
মন্তব্য করুন