প্রতিবার মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সামনে প্রশ্ন তুলে ধরে- সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে আমরা কতটা এগিয়েছি। একুশ শুধু দিনপঞ্জির তারিখ নয়; আমাদের অধিকার, গণতন্ত্র, ন্যায়ের সংগ্রামের প্রেরণা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাসংগ্রামীদের আত্মদান এখন আর শুধু বাঙালি জাতির গৌরব নয়, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বিশ্বজনীন অঙ্গীকার। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির চেতনায় যেমন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারিক পরিধি বিস্তৃত করার আহ্বান নিয়ে ফিরে আসে, তেমনি দেশের সব ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষা বিকাশের অঙ্গীকারও মনে করিয়ে দেয়। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অমানবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ও দৃঢ় করে। বিনম্র চিত্তে ভাষাশহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আমরা বলতে চাই, অধিকার রক্ষায় তাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে শপথ আমরা নিয়েছিলাম, এর কি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে? যে বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের একাধিক দেশেরই দাপ্তরিক ভাষা, সেই ভাষাকে বাঙালির রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার সূতিকাগার এই ভূখণ্ডের সর্বস্তরে কি মর্মে নেওয়া সম্ভব হয়েছে? ভাষা নিয়ে আমাদের অফুরন্ত গর্ব আছে বটে; কিন্তু এখনও যে এর চর্চা সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি এই নিরেট সত্য এড়ানোর পথ নেই। তবে সম্প্রতি আদালতে বাংলা ভাষায় রায় প্রদানের জন্য বিচার বিভাগ ও সরকারের পক্ষ থেকে ইংরেজি শব্দের সাড়ে চার হাজার নতুন বাংলা পরিভাষাসহ ১০ সহস্রাধিক বাংলা পরিভাষা নিয়ে আইন কমিশন যে 'আইন শব্দকোষ' প্রণয়ন করেছে, বিলম্বে হলেও তা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার হলেও উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় বিরল। এমন প্রেক্ষাপটে উচ্চ আদালতে যদি বাংলায় রায়সহ সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব রাষ্ট্রের সব স্তরে প্রতিভাত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলেও আমরা মনে করি। আমাদের সংবিধানে 'প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা' স্পষ্টভাবে লেখা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এর অনুপস্থিতি হতাশাজনক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন। জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদাদানের যে উদ্যোগ থেমে আছে, এর বাস্তবায়নে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা জরুরি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার ভাবমূর্তিই শুধু উজ্জ্বল হয়নি, বিশ্বের সব মাতৃভাষারই বিশেষ মর্যাদা ও মনোযোগ লাভ করেছে।

আমাদের দেশে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা। তাদের ভাষা রক্ষার যে কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে, তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আরও বিকশিত করার প্রয়াসও জোরালো করতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হচ্ছে সব জনগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা করা। এও মনে রাখতে হবে, আমরা বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলবিদ্যাসহ বহু বিষয়েই রক্তস্নাত বাংলাকে এখনও শিক্ষার বাহন করতে পারিনি। আমরা জানি, বিশ্বের অগ্রসরমান সব দেশই মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বায়নের এ যুগে যে কোনো বিষয়ে গ্রহণ-বর্জন নির্ধারণ করতে হবে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-সমাজ বিকাশের নিরিখ নির্ণয় করেই। আমাদের আত্মপরিচয় ও স্বকীয়তাবোধের জাগ্রত চেতনার গর্বের জায়গা থেকে যদি ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্য এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় সফল হওয়া যায়, তাহলেই তা হবে ভাষাশহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন। আমরা যেন একুশকে নির্দিষ্ট মাসে, আনুষ্ঠানিকতায় গণ্ডিবদ্ধ না রেখে, ইতিহাসের প্রাণহীন পাতায় গুঁজে না দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃজনে মনোযোগী হই। শুধু আবেগে ভেসে গেলে চলবে না, বরং একুশের চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে।