
জামাল নজরুল ইসলাম, (১৯৩৯-২০১৩)
বাংলাদেশে এই মানুষটিকে যতটা চেনে, তার চেয়ে বেশি চেনে বহির্বিশ্বে। তার সৃষ্টি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ। আমাজনের বই তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন তিনি। ক্ষণজন্মা এ জ্যোতির্বিদকে নিয়ে আমরা খুব কমই আলোচনা করতে দেখেছি। স্টিফেন হকিংয়ের কসমোলজি থিউরি আমরা যতটা পড়েছি, ঠিক ততটা নিজ দেশের বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুলকে কাছে টেনেছিলাম কিনা- এ প্রশ্ন তো আছেই। তবে অসম্ভব এই মেধাবী মানুষটি আমাদের গবেষণার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবেই থাকবেন।
১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বিজ্ঞানীর শিক্ষাজীবন কেটেছে কলকাতা ও চট্টগ্রামে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে গণিতে স্নাতক এই বিজ্ঞানী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ব্রিটিশ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেন ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি। অসম্ভব এই মেধাবী নিজের কাজের পরিধি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটে কসমোলজি বিজ্ঞানের গবেষকদের ওপর। ১৯৬৭ থেকে পরবর্তী চার বছর কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে কাজের সুযোগ হয় তার। এর পর আবারও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে অধ্যাপনা করেন। তার গবেষণার উচ্চমান তাকে শুধু সামনের পথই দেখায়নি; চিনিয়েছে বাংলাদেশকেও। স্বাধীনতার ১৩ বছর পর ১৯৮৪ সালে পশ্চিমা জীবনের সব মোহ ত্যাগ করে দেশে ফিরেই যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন দশকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের গবেষণার ভিত্তিকে। চেয়েছিলেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞান গবেষণার মশাল জ্বালাতে। তার চিন্তার ফসল আমরা তার প্রবন্ধে দেখতে পেয়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন 'কৃষ্ণ বিবর', 'মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ', 'শিল্প সাহিত্য ও সমাজ' বিষয়ক বই। তার ৫০টির মতো গবেষণা প্রবন্ধ আজও গবেষকরা তাদের গবেষণায় উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। একজন মননশীল জ্যোতির্বিদ হিসেবে অধ্যাপক জামাল নজরুলের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এমন সৃষ্টিশীল মানুষটির উদ্ভাবনী শক্তি আমাদের শুধু অনুপ্রেরণাই দেয় না; ভাবিয়ে তোলে দেশপ্রেম নিয়েও। ভিনদেশি ভাষা ব্যবহারের চেয়ে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যে সুফল রয়েছে, তা নিয়ে লিখেছিলেন 'বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার হাল' শিরোনামে। তিনি বলেছিলেন, বাংলায় বিজ্ঞানের বইয়ের ঢালাও অনুবাদ একটি সামাজিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। অতি মুনাফার লোভে অনেকেই তা করলেও কখনও তা ভালো ফল আনবে না। তবে আমাদের দেশে বিজ্ঞানের ইংরেজি ভাষার বই বাংলায় ভালো অনুবাদ করতে পারবেন এমন অনেকেই আছেন। তারা এসব কাজে হাত দিলে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য ভালো হতো। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হলে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা অনেকটাই এগোবে।
তার স্বপ্ন ছিল আমাদের দেশের গবেষক-বিজ্ঞানীরা মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করবেন। তিনি মনে করতেন, বাংলায় বিজ্ঞানবিষয়ক ভালো বই লিখতে হলে প্রথমে ভালো বিজ্ঞানী হতে হবে। এর পর সহজ, সাবলীল ও সহজবোধ্য শব্দে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লিখতে হবে।
তিনি মনে করতেন, দেশে বসেও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা সম্ভব। আর সে জন্য তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ভৌত গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে আমৃত্যু সেখানে নিয়োজিত ছিলেন। শ্রম ও মেধা দিয়ে গবেষণার বীজ বপন করেছিলেন। তার চিন্তাশীলতার উন্মেষ ঘটানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন। আমাদের পথ দেখিয়েছেন। আমরা তার পথকে আঁকড়ে ধরলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যেমন গড়া সম্ভব, তেমনি শিক্ষা ও গবেষণার নানার দিকনির্দেশনাও পাওয়া সম্ভব। একুশে পদকে ভূষিত জাতীয় এই বিজ্ঞানীর জন্মতিথিতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান