অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র কভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি চলছে। চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছেন। তবে গত বছরের প্রথম দিকে করোনা নিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝি ও অমানবিক ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের মধ্যে টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। এখন সবাই টিকা নিতে আগ্রহী। অনেকে কেন্দ্রে গিয়ে সুযোগ থাকলেই টিকা নিয়ে নিচ্ছেন। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে না বললেই চলে। কারও কারও সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা প্যারাসিটামল খেলেই সেরে যাচ্ছে। আমি অ্যাজমা, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের রোগী। ১১ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরের নগর মাতৃসদন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা নিয়েছি। টিকা প্রদানের পুরো ব্যবস্থাপনায় বেশ সন্তোষজনক। বাংলাদেশ সরকার এজন্য ধন্যবাদ পেতে পারে।
আমার মতো বয়স্ক মানুষ গ্রামে-গঞ্জে অনেক আছেন, যাদের অনেকেরই নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। তারা টিকা নিয়েছেন তো? নাকি ভাবছেন- বিনামূল্যে টিকা প্রদান চলছে, খারাপ কিছু ঘটলে তখন কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে? তার চেয়ে না দেওয়াই ভালো। বুড়ো মানুষ কয় দিনই-বা বাঁচবেন। তার চেয়ে যেমন আছে তেমনই থাকুক। অযথা টানা- হেঁচড়ার দরকার কী? আবার অনেক বয়স্ক ব্যক্তি মনে করেন, করোনা কই থেকে কোথায় চলে যাবে। কী দরকার টিকা দিয়ে। অন্যদিকে, উদাসীন ছেলেমেয়ের মনোভাব বয়স্ক ব্যক্তিদেরও স্বস্তি দেয় না। শহরের বস্তিতেও একই অবস্থা। তবে বয়স্ক ব্যক্তিরা অধিকাংশই ভালোভাবে নেই। অবহেলিত এবং উপেক্ষিত। কারণ করোনাকালে মানুষের খরচ বেড়ে গেছে। স্যানিটাইজার ও মাস্ক কিনতে প্রতি মাসে আলাদা খরচ হচ্ছে। আবার আয় কমে গেছে। এই পরস্পর বিপরীতধর্মী জীবনযাপনকালে পুষ্টিকর খাবারের প্রতি মনোযোগী হতে বলা হচ্ছে। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। গ্রামে যারা থাকেন তাদের নিঃসঙ্গতা তেমন থাকে না। সবাই সবাইকে সম্পর্কের খাপে ফেলে ডাকে, কথা বলে। পরিবেশও থাকে খোলামেলা। হাঁটা-চলার জায়গা থাকে। শহরের বয়স্করা অনেকেই নিঃসঙ্গ। নিম্ন মধ্যবিত্তের পরিবারে যখন বাইরে যাওয়া নিয়ে নানান নিষেধের বেড়াজাল, তখন যেন এই বিষয়গুলো সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
দু-চারজনকে ফোন করে খবর নিলাম। তারা বেসরকারি এবং সরকারি সংস্থায় নিম্নবিত্তদের নিয়ে কাজ করেন। অনেক বয়স্ক ব্যক্তিই এখনও রেজিস্ট্রেশন করেননি। তারা লেখাপড়া জানেন না। তাদের ছেলেমেয়েরা এই নিয়ে ভাবার প্রয়োজনবোধও করেন না। নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীরা টিকা নিতে পারবেন, এটা বলা হয়েছে। অনেকে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের সঙ্গে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছেন। তবে ব্রোকলি ও করলা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খুব সাহায্য করে থাকে। এই তথ্য প্রদান করা দরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের। শজিনা পাতাও অনেক উপকারী এবং সহজলভ্য। স্বাস্থ্যকর্মীরা ভুল সংশোধনে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করছেন। উপজেলা পর্যায়ে কেন্দ্রে নিয়ে এসে অনেককে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দিয়েছেন তারা। কারণ সবার কম্পিউটার বা স্মার্টফোন নেই। এটা ভালো লক্ষণ। মানুষ মানুষের জন্য। করোনাকালে নানাভাবে মানুষ তার প্রমাণ রেখেছে। তবে এই বহুমুখী লড়াই আমাদের শেষ হতে অনেক দেরি লাগবে।
আমাদের জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক বয়স্ক নারী-পুরুষ আছেন। চট্টগ্রামের একজন বাসিন্দা জানালেন, পাথরঘাটায় অনেক জেলেপাড়া রয়েছে। সেখানে টিকাদানের জন্য ওয়ার্ড পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হলে বয়স্ক ব্যক্তিরা টিকা নিতে পারবেন। নির্বাচনী উত্তেজনার কারণে অনেক বিঘ্ন ঘটেছে কাজে। জেলেপাড়াগুলো শহর থেকে সব স্থানেই একটু দূরে অবস্থিত।
মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জসহ সব স্থানেই জেলেপাড়া ও চরাঞ্চলের বয়স্ক মানুষেরা যাতে কভিড-১৯ এর টিকা পান, সেদিকে সচেতন সব মানুষকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। সবার টিকা পাওয়ার মধ্য দিয়েই করোনা দূর হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশের সব শ্রেণি ও পেশার বয়স্ক মানুষের টিকা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হোক সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী

বিষয় : বয়স্কদের টিকা নিশ্চিত হোক

মন্তব্য করুন