জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রাপ্তি হিসেবে গতানুগতিকভাবে একমাত্র জ্বালানি সাশ্রয়কে বিবেচনায় নেওয়ায় এ প্রকল্পগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয় না। প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের সঙ্গে জ্বালানি খাতের আন্তঃসংযোগ থাকায় জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি শুধু জ্বালানি সাশ্রয়ই নয়, একটি দেশের পুরো জ্বালানি ব্যবস্থাকেই প্রভাবিত করে। আমরা যেহেতু টেকসই উন্নয়নের ৭ নম্বর এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আওতায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চাই, বিভিন্ন কারখানা বিশেষ করে যেগুলো অতিমাত্রায় জ্বালানি নির্ভর, সেগুলোর জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। বাসা-বাড়িতে অনাকাঙ্ক্ষিত জ্বালানির অপচয় রোধ করাটাও জরুরি। সেইসঙ্গে নীতিমালায় জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি ও জ্বালানি সংরক্ষণ সংক্রান্ত আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো দরকার।
এ ক্ষেত্রে জ্বালানি সাশ্রয়ের সব ধরনের সুবিধার সুচিন্তিত সন্নিবেশ করে দেখতে হবে। প্রথমেই যে দিকটা চলে আসবে তা হলো জ্বালানি ব্যবহারকারীর (উদাহরণস্বরূপ কারখানাতে) আর্থিক সাশ্রয়। দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিলে কারখানা বা বাসা-বাড়িতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ফলে মোট বিদ্যুতের চাহিদা হ্রাস পাবে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় করা গেলে উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করার চাপ থাকে, এ সাশ্রয় হওয়া তহবিল অন্য খাতে কাজে লাগানো যেতে পারে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন আপাতত প্রয়োজন না হলে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় থাকবে না, যা সাশ্রয়ের আরও একটি খাত তৈরি করবে।
তবে উদ্বেগ তৈরি হতে পারে, বিদ্যুৎ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গিয়ে আবার অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে না তো? তেমন সুযোগ খুব একটা নেই। জ্বালানি দক্ষতা খাতেও কাজের সুযোগ নেহাত মন্দ নয়।
মূলত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণে ভারসাম্য রাখার চাপ থাকে। জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি যেহেতু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের প্রয়োজন কিছুটা কমাতে ভূমিকা রাখে, এ দেশগুলো সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারে বিনিয়োগ করতে পারে।

এ ছাড়া রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিপর্যয় তা জীবাশ্ম জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব। তবে স্বল্পমেয়াদি যে ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হচ্ছি, তা স্থানীয় এবং বৈশ্বিক বিবেচনায় ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সাম্প্রতিক গবেষণা এ ভয়ংকর দিকটি আরও একবার সামনে নিয়ে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে পৃথিবীর ৮৭ লাখ মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সংঘটিত বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছে। এ সংখ্যার বড় একটি অংশ চীন ও ভারতের হলেও বাংলাদেশের মৃত্যুর হার একেবারে কম নয়- বাংলাদেশে বায়ুদূষণে মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে বায়ুদূষণে চিমনিযুক্ত সেকেলে ইটভাটাগুলোর ভূমিকা অনেক। বেশ কয়েক বছর ধরে জ্বালানি দক্ষ প্রযুক্তির ওপর বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে ইট তৈরির নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হলেও অর্জন সামান্য বলা চলে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিশ্নেষণে দেখা যায়, সেকেলে এই ইটভাটাগুলো স্থাপনে বিনিয়োগ পরিবেশবান্ধব ইটভাটার তুলনায় অনেক কম হলেও পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাবের আর্থিক মূল্যায়নে সেগুলোকে অনভিপ্রেত বলা যায় নির্দি্বধায়। অন্যদিকে, জীবাশ্ম জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব 'জলবায়ু পরিবর্তন' নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির ভূমিকা নিয়ে খুব কম মানুষই আছেন, যারা দ্বিমত পোষণ করবেন।
জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়, যার প্রমাণ বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ সমপরিমাণ বিনিয়োগে জীবাশ্ম জ্বালানির তিন গুণ কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে থাকে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি। জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির চাহিদার সঙ্গে জ্বালানি সেবা প্রদানকারী কোম্পানি গঠনের সফল উদাহরণ বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। যেমন- চীন, ভারত, জার্মানি, আমেরিকা ইত্যাদি। এ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কারখানার জ্বালানি নিরীক্ষা করে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির নানা সুযোগ শনাক্ত করে। এর পাশাপাশি জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির এ সুযোগগুলো গ্রহণ করতে গেলে বিভিন্ন কারখানায় কী ধরনের প্রযুক্তি প্রয়োজন তার তালিকা এবং আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই করে থাকে। কারখানায় অভ্যাসগত পরিবর্তন কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই কতখানি জ্বালানি সাশ্রয় করতে পারে সে প্রতিবেদনও তারা প্রদান করে।
তা ছাড়া প্রযুক্তি সরবরাহ এবং কারখানায় স্থাপন করা সব ক্ষেত্রেই এ কোম্পানিগুলো পেশাদারিত্বের পরিচয় প্রদান করে থাকে। বিভিন্ন দেশে তাদের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ফলে জ্বালানি নিরীক্ষক, জ্বালানি বিশ্নেষক, আর্থিক বিশ্নেষক, জ্বালানি ব্যবস্থাপক ও কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। অবশ্যই এ ধরনের বিশেষায়িত কাজের উপযুক্ত লোকবল গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। ভারত ও সিঙ্গাপুর জাতীয় পর্যায়ে এই প্রশিক্ষণ পরিচালনার বেশ সুফল পেয়েছে।
প্রকৌশলী ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদ