সবুজ বিপ্লবের জনক ড. নরম্যান ই বোরলাগের অবদান বিশ্ববাসী কোনোদিনও ভুলবে না। বিগত শতকের ষাটের দশকে উচ্চফলনশীল শস্য আবিস্কার করে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন নরম্যান বোরলাগ। তার এই আবিস্কারে ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। এর থেকে বেশি সুফল লাভ করে ভারত উপমহাদেশ। এক হিসাব মতে, বোরলাগের উদ্ভাবনের কল্যাণে ওই সময়কার দুর্ভিক্ষ থেকে কমপক্ষে ১০০ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পায়। এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ১৯৭০ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় বিজ্ঞানী নরম্যান বোরলাগকে। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমেরিকার আইওয়া ও ভারতে তার দুটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ভারতে সর্ববৃহৎ মানবমূর্তি স্থাপন করা হয় ভারতের লৌহমানব খ্যাত বল্লভভাই প্যাটেলের। উপমহাদেশের কৃষকরাই তাকে বানিয়েছিলেন 'সরদার প্যাটেল'। তাকে স্মরণীয় করে রাখতে ভারতের মোদি সরকার বিশাল এক ভাস্কর্য বানিয়ে ফেলে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্যরূপে বিশ্বরেকর্ডে জায়গা করে নেয়।
ঠিক তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সবুজ বিপ্লবের জনকের অবদান দেশবাসী কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কৃষিবাংলার রাখালরাজা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃষিক্ষেত্রে অবদান স্মরণীয় করে রাখতে অভিনব এক চিত্রশিল্পের আশ্রয় নেন দেশের কৃষক ও কৃষিবিদরা। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন, কৃষি ছাড়া এ দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি বাংলাদেশের আপামর জনতার রাখালরাজা, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনীতির সুগঠিত কাঠামো গড়তে কৃষি খাতে উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই তো তিনি ১৯৭২-৭৩ সালের উন্নয়ন বাজেটে পাঁচশ কোটি টাকার মধ্যে একশ এক কোটি টাকা কৃষি খাতে বরাদ্দ করেছিলেন, যা বঙ্গবন্ধুর কৃষিবান্ধব নীতির কারণেই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কৃষিনীতি ও তার কৃষিবিষয়ক দর্শন ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তার স্বল্পকালীন শাসনামলে কৃষি উন্নয়নে যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তিনি প্রায় ২২ লাখ কৃষকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। তাদের মধ্যে মানসম্মত বীজ, সার, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিনামূল্যে ও নামমাত্র মূল্যে সরবরাহ করেন। তিনি প্রান্তিক কৃষকদের বিরুদ্ধে করা সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও ভূমিহীনদের মধ্যে সরকারি খাসজমি বণ্টন করে দেন। বিশ্বে আজ বাংলাদেশ কৃষি খাতে একটা রোল মডেলের নাম। সেই মডেলের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, 'কৃষক ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ, কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে সবুজ বিপ্লব সফল করে তুলুন। বাংলাদেশকে খাদ্যে আত্মনির্ভর করে তুলুন' (২৯ অক্টোবর, ১৯৭৩)। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ও অনুকরণীয় অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা 'জাতীয় কৃষি পুরস্কার' প্রবর্তন করেন, যা বর্তমানে 'বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার' নামে পরিচিত।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ব্যবহারিক কৃষি ও কৃষিশিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, এ দেশের কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধি, খাদ্য ঘাটতি পূরণ ও অধিক পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের জন্য দেশের কৃষিবিদদের সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। মেধাবীরা যে বিষয়েই জ্ঞান অর্জন করুক না কেন, সে বিষয়ে তারা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। অতএব, কৃষিবিদদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে তিনি ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃষি বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদমর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন, 'আমি তোদের পদমর্যাদা দিলাম, তোরা আমার মান রাখিস।' ফলে কৃষি শিক্ষায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রবেশ বাড়তে থাকে। পরে ১৯৭৭ সালের বেতন কাঠামোয় কৃষিবিদদের সেই মর্যাদা আবারও এক ধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়। কৃষিবিদদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার কৃষিবিদদের সেই হারানো সম্মান আবার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর কারণে আজকে আমরা কৃষিবিদরা গর্ব করে বলতে পারি, 'বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান।' কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে দেশের কৃষিবিদদের অবদান শুধু একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল দুই কোটি ৮০ লাখ টন। এর মধ্যে পরবর্তী এক যুগে জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৪ লাখ হেক্টর আর খাবারের মুখ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০ কোটি। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় চার কোটি ৩২ লাখ ১১ হাজার টন, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিনিয়ত দেশের কৃষি খাতে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাচ্ছে আর দেশ পরিণত হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক সোনার বাংলায়। যেমনটি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। বাংলার মানুষ পেট ভরে খাবে। এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য!'
শুরু করেছিলাম একটি চিত্রকর্মের গল্প থেকে, শেষও করব একটি ভিন্নধর্মী চিত্রশিল্প দিয়ে। এখানে তুলি হলো সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষাদের হাত, রং হলো দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান, আর ক্যানভাস হলো সোনার বাংলাদেশের সবুজ মাঠ। সেই তুলি, রং আর ক্যানভাসে অঙ্কিত হচ্ছে জাতির পিতার শস্যচিত্র। বগুড়া জেলার শেরপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের বালেন্দা গ্রামে কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সভাপতিত্বে 'শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ'-এর উদ্যোগে ও ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ারের সহযোগিতায় ১২০ বিঘা জমির ওপর ব্যতিক্রমী এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মুজিববর্ষের শুরুতেই এই সুবিশাল কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ। প্রায় পাঁচ মাস আগে চীন থেকে সবুজ ও বেগুনি রঙের হাইব্রিড ধানের জাত আমদানি করা হয়। এরপর বীজতলা তৈরি, চারা উৎপাদন এবং গত ২৯ জানুয়ারি চারা রোপণের মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয় এই মহৎ কর্মযজ্ঞের। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ বাংলাদেশ কৃষক লীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম মাহবুবুল হাসান মাহবুবসহ আরও অনেকে। রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৯ সালে চীন আট লাখ ৫৫ হাজার ৭৮৬ বর্গফুট একটি শস্যচিত্র তৈরি করেছিল। আর বাংলাদেশের এই নান্দনিক শস্যচিত্রটির আয়তন হবে সেটির চেয়ে প্রায় দেড় গুণ, অর্থাৎ ১২ লাখ ৯২ হাজার বর্গফুট। সব শর্ত মেনে কাজটি শেষ করা হলে তা হবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে 'লারজেস্ট ক্রপ ফিল্ড মোজাইক (ইমেজ)' শাখার নতুন বিশ্বরেকর্ড। গোটা বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নাম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই নেবে আর অর্জিত হবে বাংলাদেশে একটি নতুন ইতিহাস, যা হবে মুজিববর্ষের একটি অন্যতম সেরা অর্জন।
অধ্যাপক, পশুপুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়