ভাষা সবসময়ই নদীর মতো বহমান। বিভিন্ন সময়, সভ্যতা ও তথ্য-প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে ভাষার পরিবর্তন হয় এবং কালের প্রয়োজনেই নতুন শব্দ তৈরি হয়। বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। চীনের উহানে করোনা শুরুর পর থেকে বিশ্বব্যাপী এক বিশাল পরিবর্তন এসেছে। ফলে, আমাদের ভাষার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। আমাদের শব্দভান্ডারে যোগ হয়েছে কিছু নতুন শব্দ, আবার পুরোনো অপ্রচলিত কিছু শব্দ নতুন করে প্রচলিত হয়েছে কিংবা নতুন অর্থ নিয়ে ফিরে এসেছে। ২০১৯ সালেও যে শব্দগুলো ছিল আনকোরা বা একেবারে অপ্রচলিত, ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতিতে সে শব্দগুলোই আমাদের জীবনযাপনের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। যেমন- অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে আলোচিত শব্দের মধ্যে আছে করোনাভাইরাস, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, প্যানডেমিক, লকডাউন, পিপিই, ফেস মাস্ক। এ শব্দগুলোর সঙ্গে কলিনস ডিকশনারিতে এ বছরের আলোচিত শব্দের তালিকায় আরও আছে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং। করোনাকালে বাংলা ভাষায় যেসব নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এবং প্রধানতম হলো 'কভিড-১৯'। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনার প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয়, তাই ১৯ সংখ্যাটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে অনেকের কাছে রোগটি করোনা নামে পরিচিত। কাজেই সাম্প্রতিক বাংলা ভাষায় সর্বাধিক ব্যবহার করা শব্দ নিঃসন্দেহে করোনা। বাংলাদেশে এর সঙ্গে মিল রেখে করোনাকাল, করোনাযুদ্ধ, করোনাজয়ের মতো কিছু শব্দ চালু হয়েছে। সংক্রামক এই রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি শব্দ হলো কোয়ারেন্টাইন, বাংলায় একে বলা হয় সঙ্গনিরোধ। যদিও এটি প্রচলিত হয়নি কোয়ারেন্টাইনের মতো। কোয়ারেন্টাইনের অর্থ হলো বিচ্ছিন্ন ও সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে অন্য কেউ এসে যাতে অসুস্থ হয়ে না পড়ে তার জন্য সেই ব্যক্তির চলাচলের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা। ২০২০ সালের সেরা শব্দ হিসেবে কেমব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে 'কোয়ারেন্টাইন'কে। এই শব্দটি তাদের অভিধানে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছে। আর কোয়ারেন্টাইনে থাকার কাজটা যখন কেউ নিজের বাড়িতে নির্দিষ্ট একটি ঘরে অবস্থান করে নিশ্চিত করে, তখন তাকে হোম কোয়ারেন্টাইন বলে। অন্যদিকে, কোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে সুস্থ ব্যক্তিদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়। এটাকে বলে আইসোলেশন। কিছুটা কঠিন উচ্চারণের এই শব্দটিকে খুব সহজভাবেই আমরা বাংলাভাষীরা গ্রহণ করে নিয়েছি। আগে লকডাউন দ্বারা মূলত বোঝানো হতো 'কারাগারে নিরাপত্তার কারণে কোনো কয়েদিকে সব সময় বন্দি রাখা।' কিন্তু করোনাকালে লকডাউনের নতুন অর্থের প্রচলন ঘটেছে। সংক্রমণ রোধে কোনো এলাকাকে অবরুদ্ধ করে রাখাই করোনাকালের লকডাউন। এছাড়া, কলিনস ডিকশনারি ইতোমধ্যে 'লকডাউন'কে ২০২০ সালের সর্বাধিক ব্যবহূত শব্দ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্যানডেমিক, এপিডেমিক বা মহামারি এবং ভ্যাকসিন বা টিকা শব্দগুলো বেশি আলোচনায় আসে করোনাকালে। প্যানডেমিক এসেছে প্রাচীন দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। গ্রিক প্যান অর্থ সবাই, আর ডেমোস অর্থ মানুষের ভিড়। সতেরো শতক থেকে প্যানডেমিক শব্দটির ব্যবহার মূলত এই অর্থে- যে রোগ সব মানুষকে সংক্রমিত করে। বাংলায় এই শব্দের অর্থ বৈশ্বিক মহামারি কিংবা অতিমারি। অন্যদিকে, বছরজুড়ে ভ্যাকসিন বা টিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। করোনাকাল যত দীর্ঘায়িত হয়েছে, ততই মানুষ বুঝতে পেরেছে একমাত্র টিকাই পারে এই অবস্থা থেকে পুরোপুরি মুক্তি দিতে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনার টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। তাই, অন্যান্য শব্দের চেয়ে বর্তমানে ভ্যাকসিন শব্দের ব্যবহার সর্বাধিক।
গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুলোর একটি ছিল মাস্ক। মাস্কের আভিধানিক অর্থ মুখোশ, ছদ্মবেশ বা মুখোশ পরে অভিনয়। তবে এই সময়ে মাস্ক শব্দটি ব্যবহার হয়েছে করোনা সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার উপকরণ হিসেবে, মুখোশ বা ছদ্মবেশ হিসেবে নয়। 'সোশ্যাল ডিসটেন্সিং' আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যা সাধারণত কভিড-১৯ যুগে সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এর বাংলা করা হয় সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব। বাংলা ভাষায় শব্দটির ব্যবহার নতুন হলেও এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয়েছিল ১৯৫৭ সালে এবং তখন এটাকে বর্ণনা করে বলা হয়েছিল, যে কোনো ভাইরাসের সংস্পর্শে না আসার জন্য সামাজিক দূরত্ব প্রয়োজন। অন্যদিকে, স্যানিটাইজার বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, অ্যাসিম্পটোমেটিক, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মতো কিছু জটিল শব্দকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অ্যাসিম্পটোমেটিক ও কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের বাংলা যথাক্রমে উপসর্গহীন ও গোষ্ঠী সংক্রমণ হলেও বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দগুলোই ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সাথে সম্পর্কিত আরেকটি শব্দ হলো হার্ড ইমিউনিটি, যাকে বাংলায় বলা হয় গণরোগ প্রতিরোধ। গণহারে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভের এই অবস্থাকে বলে হার্ড ইমিউনিটি। নব উদ্ভূত এই ইংরেজি শব্দটি বাংলা ভাষায় একটি সুস্পষ্ট জায়গা দখল করে নিয়েছে। একইভাবে, কনটেইনমেন্ট জোন, পল্গাজমা থেরাপি, পিপিইর মতো ইংরেজি শব্দগুলো কোনো বাংলা অনুবাদ ছাড়াই হরহামেশা ব্যবহূত হচ্ছে। সকলেই পিপিইর পূর্ণ অর্থ না জানলেও এটুকু জানেন যে, এটি একটি বিশেষ ধরনের পোশাক যেটি স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের মরণ ভাইরাসের সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করবে। স্বাস্থ্য কর্মী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে সম্পর্কিত ও বাংলা ভাষায় নবাগত একটি শব্দ হলো 'ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র, যার বাংলা করা হয়েছে 'সম্মুখযোদ্ধা'। অবহেলিত স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল সুবিধায় তারা যে কাজটি করছেন, সেটিও আরেক যুদ্ধ। তাই বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল সম্মুখযোদ্ধা শব্দটি।
এছাড়া করোনাকালে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত-সমালোচিত আরেকটি শব্দ হলো আইইডিসিআর। শব্দটির পূর্ণরূপের বাংলায় বলা হয়- 'রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট'। বর্তমানে সারা বিশ্বের আলোচিত একটি ধারণা 'হোম অফিস'। ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে যখন সবাই ঘরবন্দি, তখন প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিজেদের ঘর থেকেই সম্পন্ন করেছেন কর্মীরা। আবার, কর্মজীবী মানুষের জন্য যেমন হোম অফিস, তেমনি শিক্ষার্থীদের জন্য 'অনলাইন ক্লাস' আলোচিত শব্দ। বাড়িতে বসেই শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ক্লাসরুমে অংশ নিচ্ছেন অনলাইনের মাধ্যমে। আর দুটিই সম্ভব হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপগুলোর মাধ্যমে। করোনাকালে যে অ্যাপটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল, সেটি 'জুম'। গত বছরের মার্চেও অ্যাপটির কথা তেমন একটা মানুষ জানত না, সেটিই রাতারাতি সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত অ্যাপে পরিণত হয়। এগুলো ছাড়াও 'গুগল ক্লাসরুম', 'গুগল মিট'-এর মতো বেশ কিছু শব্দেরও আগমন ঘটেছে বাংলা ভাষায়। করোনাকালে মানুষের জীবনযাপনের ধরন পাল্টে গেছে। আগে সারাদিন মুখে মাস্ক পরে থাকতে হতো না, কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়ার ঝক্কি ছিল না। কাজের জায়গা, ঘরোয়া জীবনে তাতেও বড় বদল এসেছে। সব মিলিয়ে আগের স্বাভাবিক জীবনের চেয়ে এ জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। তাই বিদায়ী বছরের অন্যতম আলোচিত শব্দগুচ্ছ 'নিউ নরমাল' যার বাংলা করা হয়েছে 'নতুন স্বাভাবিক'। বাংলা ভাষায় এটি একটি নতুন শব্দ যা দ্বারা সার্বিক নব্য পরিস্থিতি প্রকাশ করা হচ্ছে। এছাড়া কিছু পুরোনো বাংলা শব্দ যেমন- 'স্বাস্থ্যবিধি', 'সীমিত পরিসরে' প্রভৃতির ব্যবহার বারবার আলোচনায় এসেছে। তবে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ করোনাকালে প্রায় প্রতিদিনই ব্যবহার করছি আমরা; এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভেন্টিলেটর, পল্গাজমা, অক্সিমিটার, ওয়েবিনার, ডিজ-ইনফেক্ট, অ্যান্টিবডি, অ্যান্টিজেন ইত্যাদি।
কভিড-১৯ যেমন আমাদের জীবনযাত্রাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে, তেমনি এটি বিশ্বনাগরিকের প্রতিদিনের শব্দভান্ডারে অনেক নতুন শব্দও প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। বাংলায় এই শব্দগুলোর অনেক ক'টিই এসেছে ইংরেজি থেকে, বেশ কিছু বাংলা ভাষার হলেও সেগুলো অভিধানেই বন্দি ছিল এতদিন, করোনা নতুন করে তা মুক্ত করে আমাদের মুখে দিয়েছে। এখন একটি প্রশ্ন বারবার মনে আসে, সেটি হলো করোনাকালের পরও কি শব্দগুলো থাকবে? কোয়ারেন্টাইন শব্দটি যেমন ৫০০ বছরের বেশি পুরোনো, এখনও টিকে আছে, তেমনি হয়তো লকডাউন টিকে যাবে, আবার না-ও হতে পারে। অনেক সময় শব্দ আদি অর্থ বদলে টিকে যায়। কিন্তু শেষমেশ কী হবে, সেটি যেমন ভাইরাসের বেলায় বলা যায় না, তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও কেউ-ই বলতে পারবেন না।
অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়